রাজবাড়ী জেলা প্রতিনিধি,
রাজবাড়ীর বিভিন্ন হাট-বাজারে উঠতে শুরু করেছে হালি পেঁয়াজ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। ফলে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে পেঁয়াজে। কিন্তু তাতে কৃষকের মুখে হাসি নেই। তাদের অভিযোগ, বাজারে যে দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে তাতে ন্যায্যমূল্য তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই উঠছে না।
জানা গেছে, মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারাদেশের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাজবাড়ী জেলা। দেশে উৎপাদিত মোট পেঁয়াজের ১৪ শতাংশ উৎপাদন হয় এ জেলা থেকে। জেলার পাঁচ উপজেলায় কমবেশি পেঁয়াজের আবাদ হলেও পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালীতে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয়।
জেলায় মুড়িকাটা ও হালি পেঁয়াজের আবাদ করেন চাষিরা। এখন ক্ষেত থেকে হালি পেঁয়াজ সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। পুরুষরা মাঠ থেকে পেঁয়াজ তুলে বাড়ির উঠানে নামাচ্ছেন। নারীরা সেই পেঁয়াজ পরিষ্কার করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়া অনুকূল থাকায় চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষে কৃষি বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এ বছর রাজবাড়ীতে ৩৪ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ২ হাজার ৮৬৫ হেক্টর বেশি। এর মধ্যে মুড়ি কাটা ৫ হাজার ২১৫ হেক্টর, কদম (কালী) ১৯৫ হেক্টর ও হালি পেঁয়াজ ২৯ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এ বছর জেলায় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬৯৮ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে।
সরেজমিনে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি, নারুয়া বহরপুর, বাণিবহসহ বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেখা যায়, ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ তুলে হাটে বিক্রি করতে এনেছেন চাষিরা। হাটের চারদিকে পেঁয়াজের ছড়াছড়ি। পাইকারদের হাঁকডাকে বাজার সরগরম। সরবরাহ বেশি হওয়ায় দাম কমে যাওয়ায় হতাশ চাষিরা।
পেঁয়াজচাষিরা জানান, সবচেয়ে ভালো পেঁয়াজ প্রতি মণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। গুনতে হচ্ছে লোকসান।
কৃষকদের দাবি, তাদের প্রতি মণ পেঁয়াজে লোকসান যাচ্ছে ৪০০ টাকা। পেঁয়াজ উৎপাদন করতে তাদের যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে, তাতে করে পেঁয়াজের মূল্য বাজারে কম হওয়ায় লাভের চেয়ে লোকসান হচ্ছে বেশি। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করা না হলে লোকসান আরও বাড়বে।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুরের পেঁয়াজচাষি রহমান শেখ বলেন, রাজবাড়ীতে পাখি হিসেবে জমি চাষ করা হয়। এখানে ২২ শতাংশে এক পাখি ধরা হয়। ২২ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ চাষে খরচ হয়েছে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ বছর অতিবৃষ্টিতে ফলন ভালো হয়নি। প্রতি পাখি জমিতে ৩০ মণ পেঁয়াজ উৎপদন হবে। বর্তমান সর্বোচ্চ বাজার দরে ৩০ মণ পেঁয়াজের দাম ২১ হাজার টাকা। যেখানে ক্ষতি থেকে যাচ্ছে ৩ হাজার টাকা। যারা বছর চুক্তি জমি নিয়ে চাষ করেন তাদের ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
নারুয়া ইউনিয়নের কৃষক একুব আলী বলেন, এ বছর চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছি। গড়ে প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। কিন্তু অসময়ের বৃষ্টির কারণে কাঙ্ক্ষিত আবাদ হয়নি। এছাড়া পেঁয়াজের বাজার মূল্য কম থাকায় লাভ হবে না।
কালুখালী উপজেলার হরিণবাড়িয়া এলাকার কৃষক আবুল পাটোয়ারী বলেন, বর্তমানে বাজারে পেঁয়াজে দাম নেই। মানভেদে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এই দামে বিক্রি করলে তো আমাদের লাভ থাকছে না। ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা মণ হলে আমাদের কিছু লাভ হবে। এছাড়া এখনকার পেঁয়াজ বেশি দিন ঘরে রাখাও যাচ্ছে না, তাই বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজবাড়ীর জেলা কৃষকলীগ নেতা রাজু আহম্মেদ বলেন, আমরা কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখেছি। প্রতিটি বাজারে প্রতি মণের ওপর ৩-৪ কেজি করে বেশি নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবস্থার পরিত্রাণ হওয়া দরকার। এ বছর কৃষকরা পেঁয়াজ বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বালিয়াকান্দি বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী গালিব ট্রেডার্সের মালিক মো. রইচ উদ্দীন বলেন, বর্তমানে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বেশি। সে কারণে পেঁয়াজের দাম কম। মানভেদে ৭০০/৮০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক এস এম শহীদ নূর আকবর বলেন, এ বছর পেঁয়াজ উৎপাদনে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে কিছু পেঁয়াজ ক্ষেত নষ্ট হলেও আমাদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভরা মৌসুম বলে এখন একটু পেঁয়াজের দাম কম। তবে পেঁয়াজের দাম বাড়বে। এ বছর রাজবাড়ীতে পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।