ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক
বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের সিংহভাগই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন । একারণে তাদের উপযুক্ত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন জরুরী।
সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর ‘দেশে ফিরে আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিলস গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিলস নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাকিল আখতার চৌধুরী, মো. আব্দুল ওয়াহেদ, পূলক রঞ্জন ধর, বিলস পরিচালক নাজমা ইয়াসমীন, উপ-পরিচালক এম এ মজিদ প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে বিলস নেতারা বলেন, প্রত্যাবাসী অসহায় নারী শ্রমিকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের বিষয়ে গুরুত্ব নিয়ে কাজ করা দরকার। বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ এবং এর ধারাবাহিক পর্যালোচনা করা দরকার। এই গবেষণা তার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।
গবেষণায় বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, তাদের প্রতি বিদ্যমান সামজিক মনোভাব, তাদের পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুর্নবাসনে প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে আনা হয়।
বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের উন্নয়নে বিলস এর গবেষণায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সুপারিশগুলো হলো- প্রত্যাবাসী নারী শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা, উপযুক্ত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি উপযুক্ত বাণিজ্যিক পরামর্শ দেওয়া, মনো-সামাজিক পরামর্শসহ উপযুক্ত স্বাস্থ্য সহায়তা দেওয়া, পদ্ধতিগত নিবন্ধন এবং তথ্য সংগ্রহের ওপর জোর দেওয়া, উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রবর্তন যা দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
এছাড়া সংগঠন, নিবন্ধন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ায় ট্রেড ইউনিয়নকে সম্পৃক্ত করা এবং ক্রমান্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি-কাঠামো প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া, নীতি ও আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ গিয়ে ২৩ শতাংশ নারী শ্রমিক এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশে ফিরেছেন, ১৮ শতাংশ এক বছরের সামান্য বেশি সময় থেকেছেন, ৫৫ শতাংশ নারী শ্রমিকের দেশে ফেরত আসা ছিল জবরদস্তিমূলক।
এছাড়া দেশে ফেরত আসা প্রতি ৩ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে ১ জনের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে অবনতি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে সিংহভাগই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৮৫ শতাংশ তাদের বর্তমান কাজ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত এবং ৫৭ শতাংশ তাদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে চিন্তিত। ৫২ শতাংশ বিদেশে জবরদস্তিমূলক শ্রমের শিকার হয়েছেন, ৬১ শতাংশ বিদেশে খাদ্য ও পানির অভাবে ভুগেছেন, ৭ শতাংশ যৌন এবং ৩৮ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদেশ ফেরত ৬০ শতাংশ নারী শ্রমিক বেকার, ৬৫ শতাংশ শ্রমিকের নিয়মিত মাসিক কোনো আয় নেই, ৬১ শতাংশ শ্রমিক এখনও ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন, ৭৫ শতাংশ শ্রমিকের কোনো সঞ্চয় নেই এবং ৭৩ শতাংশ শ্রমিক তাদের পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন।
বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের শারীরিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নাজুক। ৫৫ শতাংশ শ্রমিক শারীরিকভাবে অসুস্থ, ২৯ শতাংশ এর মানসিক অসুস্থতা রয়েছে এবং ৮৭ শতাংশ শ্রমিক মানসিক অসুস্থতার কোনো চিকিৎসা পায়নি। বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকরা সামাজিকভাবেও হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন।
পরিবার ও সমাজ তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। ৩৮ শতাংশ নারী শ্রমিক বলছেন সমাজে তাদের নিম্ন শ্রেণির চরিত্রহীন নারী বলে গণ্য করা হয়।
গবেষণায় প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকরা তাদের পরিবার ও সমাজের কাছে অবহেলিত। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর মধ্যে তারা নিজেদের অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিয়ে ছিলেন। বর্তমানে বেশির ভাগেরই পরিবার বা সমাজে মতামতের কোনো মূল্য নেই। তাদের কেউ গ্রাহ্য করে না।
তাদের কেউ বিশ্বাস করে না। বিদেশ থেকে ফেরার সময় পরিবারের সদস্য দ্বারা বিমানবন্দরেই অযাচিত আচরণের শিকার হয়েছেন ১৭ শতাংশ শ্রমিক। ১৫ শতাংশ বিদেশ থেকে ফিরে আসা নারী তালাকপ্রাপ্ত হয়েছেন। ১১ শতাংশ নারী শ্রমিকের স্বামী তাদের ছেড়ে চলে গেছেন এবং ২৮ শতাংশ নারী শ্রমিক তাদের দাম্পত্য জীবনে বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছেন।
তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিছু কিছু বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিক তাদের অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা ভালো পরিবেশে কাজ করে, ভালো পরিমাণে রেমিট্যান্স আয় করেছেন এবং তাদের ভাল সঞ্চয় রয়েছে। তাদের নিয়মিত আয়ের উৎস রয়েছে। তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবেও সুস্থ।
উল্লেখ্য, বিলস দেশের তিনটি জেলার (চট্টগ্রাম, যশোর এবং ফরিদপুর) ৩২৩ জন প্রত্যাবাসী অভিবাসী নারী শ্রমিকের ওপর জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া, গুণগত গবেষণা পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রাথমিক উৎসগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।