ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ৭২ বিলিয়ন আর পাইপলাইনে রয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কঠিন শর্তে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া ও প্রকল্পে দুর্নীতিসহ নানা কারণে সম্প্রতি ভেঙে পড়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে জনরোষ। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের আশঙ্কা, বাংলাদেশের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। তবে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ (ইআরডি) সংশ্লিষ্টরা এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন।
তারা বলছেন, যে কোনো প্রকল্পের আউটকাম তথা রিটার্নের বিষয়টি মাথায় রেখেই সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৬১ শতাংশেরও বেশি, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, কোনো একটি দেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাতের ২০ শতাংশকে আদর্শ ধরা হয়। সেদিক থেকে জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশের বর্তমান ঋণ ১৬ শতাংশ। ঋণের এ অনুপাতই বলছে, শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক বেশি দৃঢ় ও স্থিতিশীল। তবে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ৯ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ঋণ প্রতিশ্রুতি এসেছে ৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই মোট ঋণের মধ্যে চীনের অবদান মাত্র ৮ শতাংশ। সেটিও আবার স্বল্প সুদে (২ শতাংশের কম সুদে) চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ। এ কারণে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) দাবি, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে- এটা ভুল ও কল্পনাপ্রসূত ধারণা।
ইআরডির অতিরিক্ত সচিব (বৈদেশিক সাহায্য বাজেট ও হিসাব শাখা) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা বাংলাদেশের হবে না। কারণ, বাংলাদেশ সবসময় স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে থাকে। নানা উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, ফলে আউটকাম অনেক বেশি হবে।
শ্রীলঙ্কার এ নাজুক অর্থনীতির কারণ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় ব্যক্তিঋণ বেশি। ব্যক্তিঋণে একদিকে যেমন সুদহার বেশি অন্যদিকে স্বল্প সময়ে পরিশোধ করতে হয়। শ্রীলঙ্কা মূলত পর্যটননির্ভর একটি দেশ। করোনায় সবকিছু থমকে যাওয়াই বর্তমান অবস্থার মূল কারণ। তবে আমাদের কোনো ব্যক্তিঋণ নেই। সব ঋণ সরকার নিয়ে থাকে স্বল্প সুদে।
উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের সবই ইআরডির মাধ্যমে চুক্তিতে। ইআরডি সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ। এরপরই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অবদান ২৩ শতাংশ। এছাড়া মোট ঋণের ১৮ শতাংশ জাপানের, ১ শতাংশ দক্ষিণ কোরিয়ার, আইডিবির ১ শতাংশ, আইএফএডির ১ শতাংশ এবং ঋণের ১২ শতাংশ অবদান অন্যান্য দেশের।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ অবদান
স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে মোট সাড়ে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করেছে। এর মধ্যে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঋণ ছাড় করেছে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি ঋণ এসেছে কমোডিটি এইড বাবদ। এর পরই ১৮ বিলিয়ন ছাড় করেছে এডিবি। জাপানের ছাড় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে তুলানায় ঋণ ছাড়ের ধারেকাছে নেই চীন। একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪ বিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে ৩ বিলিয়ন, রাশিয়া ৩ বিলিয়ন ডলার, কানাডা ও জার্মানি সমান ২ বিলিয়ন ডলার করে, ইউনিসেফ দেড় বিলিয়ন, ভারত ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন, নেদারল্যান্ডস ১ বিলিয়ন, ডেনমার্ক ১ বিলিয়ন, সৌদি ১ ও সুইডেন ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ ছাড় করেছে।
চীন ঋণ ছাড় করেছে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
নানা উন্নয়ন প্রকল্পে চীন ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৮ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ছাড় হয়েছে। ফলে আরও প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের চীনা ঋণ পাইপলাইনে রয়েছে।
ভারতের ঋণ প্রতিশ্রুতি ৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন
প্রতিবেশী দেশ ভারতের মোট ঋণের প্রতিশ্রুতি ৭ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন। পাইপলাইনে আছে ৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় ঋণ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় নেই এটা ঠিক। তবে দেশের ম্যানেজমেন্ট যদি ঠিক না থাকে তবে অবস্থা সেরকম হতে কতক্ষণ? তাই যথাযথ প্রকল্প নিতে হবে, যেন রিটার্ন ভালো আসে।
চীনা ঋণ কতটা ক্ষতিকর, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঝুঁকি এড়াতে কন্ডিশন বুঝে চীনের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে। ঋণের কন্ডিশনকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। শ্রীলঙ্কায় চীনা ঋণের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ দোষারোপ করা ঠিকও হবে না। তবে একটা কথা বারবারই বলবো- ঋণ নিতে হবে ভেবেচিন্তে। যেন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ঠিকঠাক রিটার্ন আসে।
বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধের সক্ষমতা বেড়েছে
বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সব চুক্তিই হয় ইআরডির মাধ্যমে। সরকারি সংস্থাটি বলছে, আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছর ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ, ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা সুদ বাবদ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাঁদা ও শেয়ার মূলধন বাবদ ব্যয় হবে ৭৪০ কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এ তিন খাতে আগামী অর্থবছর মোট ব্যয় হবে ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছর এ তিন খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২১ হাজার ২৯২ কোটি ৮২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যয় বাড়ছে ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
গত অর্থবছর (২০২০-২১) এ তিন খাতে ব্যয় হয়েছিল ১৬ হাজার ৪৪৫ কোটি ৫৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। আগের অর্থবছর (২০১৯-২০) ব্যয় হয় ১৪ হাজার ৮৩৪ কোটি ৭৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে ঋণ ও সুদ পরিশোধের সক্ষমতা।
সরকারের ঋণ এখন জিডিপির ১৬ শতাংশ
বর্তমানে সরকারের ঋণ জিডিপির ১৬ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যা ছিল ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৭০ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের ঋণ ছিল ডিডিপির ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
স্বল্প সুদে জাপানের ঋণ
বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র জাপান। স্বল্প সুদে ঋণদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারাকে বেগবান করছে পূর্ব এশিয়ার এ দ্বীপ দেশটি। জাপান সরকারের ঋণের সুদহার দশমিক ৭০ শতাংশ। ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
জাপানের পরই দ্বিতীয় সর্বনিম্ন সুদে ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশকে সহজ শর্তে ঋণ দেয় সংস্থাটি। ৩৮ বছরে পরিশোধ করতে হয় ঋণ। এর মধ্যে ছয় বছর গ্রেস পিরিয়ড। আর ঋণের সুদের হার দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের স্কেল আপ ফ্যাসিলিটি (এসইউএফ) তহবিলের ঋণের সুদের হার ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অর্থ পরিশোধের সময়ও কম। ৩০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এর মধ্যে গ্রেস পিরিয়ড ৯ বছর। এছাড়া অনুত্তোলিত ঋণের স্থিতির ওপর বার্ষিক দশমিক ২৫ শতাংশ প্রতিশ্রুতি ফি দিতে হবে।
সংস্থাটির সুদের হার শূন্য থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কার্যকর করেছে। এর সঙ্গে আগে থেকে অব্যাহত থাকা সার্ভিস চার্জ দশমিক ৭৫ শতাংশ বলবৎ রয়েছে। সব মিলিয়ে এখন সুদের হার দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। এডিবির সহজ শর্তের এ ঋণের বার্ষিক সুদের হার ২ শতাংশ। এই ঋণ পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ (সুদ, আসল বা ঋণের কিস্তি দিতে হবে না) ২৫ বছরে পরিশোধ করতে হবে।
ভারতীয় ঋণে সুদ
ভারতীয় ঋণেও কিছু শর্ত আছে। শর্ত অনুযায়ী, ভারতীয় ঠিকাদাররা এসব প্রকল্পের কাজ পাবেন। পূর্তকাজে ৬৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা এবং অন্য প্রকল্পে দেশটি থেকে ৭৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা আনতে হবে। ঋণের সুদহার ১ শতাংশ ও কমিটমেন্ট চার্জ হবে দশমিক ৫ শতাংশ। ৫ বছর রেয়াতকালসহ ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।
চড়া সুদে চীনা ঋণ
চড়া সুদে ঋণ দেয় চীন। সুদের ফ্ল্যাট রেট ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য চার্জ মিলে সাড়ে চার থেকে পাঁচ শতাংশ সুদ গুনতে হয় বাংলাদেশকে।
সূত্র: জাগো নিউজ