মহামারী করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে বার বার লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। অনেক কর্মজীজীর আয় রোজগার
কমে গেছে। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের ৪ কোটি
পরিবারের মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ, উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই
কোটি পরিবার হবে।
সরকারি গবেষনা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলেছে করোনাভাইরাস মহামারীর আঘাতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে
দরিদ্র সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষনা সংস্থা ব্রাক ও পিপিআরসি বলছে আগে দেশের ২০ ভাগ মানুষ দরিদ্র ছিল।
এখন সেটা আরও ৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ শতাংশে উঠেছে। সামনের দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করে সংস্থা দুটি।
নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষকে কাজ না দিতে পারলে দারিদ্রসীমার ভয়াবহতা আরও প্রকট হবে। এতে আমাদের সব ধরনের উন্নয়ন
বাধাগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী করোনার আগে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্টির ২০
দশমিক ৫ ভাগ দারিদ্রসীমার নিচে ছিল। চরম দারিদ্রে ছিল ১০ ভাগ মানুষ। করোনা মহামারির কারনে এখন সেটা দ্বিগুন
হয়েছে বলে বেসরকারি কয়েকটি গবেষনা সংস্থা তথ্য প্রকাশ করেছে। বিআইডিএসের সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়েছে
করোনায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরীব হয়েছে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরীব মানুষের
সংখ্যা ৫ কোটির বেশী। (তথ্যসূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৫ জুলাই ২০২১।)
অসহায়দের পাশে দাড়ানো মানবিক দায়িত্ব
দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের জন্য সম্প্রতি তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্যাকেজ ঘোষনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই প্যাকেজের আওতায় ঈদুল আযহার আগে ১৭ লাখ ২৪ হাজার দিন মজুর, পরিবহন শ্রমিক এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার নগদ সহায়তা বিতরণ করা হয়েছে। ২৩ জুলাই ২০২১ শুরু হওয়া দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাইনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্রদের জন্য এই অর্থ বিছুটা হলে এ স্বস্তি দেবে। এর আগে গত বছরের এপ্রিলে অসাধারণ ছুটির পর সবকার ৩৫ লাখ মানুষকে ২৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দিয়েছিল। রিক্সা চালক, দিন মজুর, নির্মাণ শ্রমিক পরিবহন শ্রমিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষকরা এ সহায়তা পেয়েছিলেন।
প্রয়োজনের তুলনায় এ সংকঠের সময় সরকারি সাহায্য অপ্রতুল হলেও সরকার তার সাধ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষের পাশে আছে।
এখন প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগের সমন্বয় ঘটিয়ে সংক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্ঠা করা। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সচেতন করা। অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানো আমাদের মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব। মানুষ গত ১০০ বছরে এতটা বিপন্ন বোধ করেনি।
করোনাভাইরাস পৃথিবীর প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে আঘাত আনছে। এমতাবস্থায়
বাংলাদেশ সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচী দেশের মানুষের মনে সাহস যোগায়। দেশের সামর্থ্যবান কিছু কিছু বড় বড় ব্যবসায়ীরা
ও অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন, যেমন বসুন্দরা গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, প্রাণ আর এফ এল গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ,বেঙ্গল
গ্রুপ সহ অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।স্থানীয় ভাবেও কিছু কিছু বিত্তশালী মানুষ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সমূহ
মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় গুণ হলো বিপদাপদে মানুষ একজনের পাশে অন্যজন দাড়ায়।
অতীতে সকল দূর্যোগেই মানুষ অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছে। ঘুর্ণিঝড় কবলিত মানুষ, বণ্যা কবলিত মানুষ আইলা সিডর
কবলিত মানুষ শীতার্থ মানুষ সহ সকল বিপদাপদে আমাদের প্রবাসী সহ দেশের মানুষ বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাড়ানোর নজীর
রয়েছে। বর্তমান করোনা কালীন মহা সংকটে দেশের সকল সামর্থবান মানুষ জাতীয় ও স্থানীয় ভাবে সংঘবদ্ধভাবে প্রণোদনা ফান্ড
তৈরী করে নিম্নবিত্ত সকল মানুষের পাশে দাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনেকরি।
অসহায়দের পাশে দাড়ানো মানবিক দায়িত্ব
পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বিত্তশালী মানুষ ও প্রতিষ্ঠান যার যার অবস্থান থেকে এককভাবে নিম্নবিত্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাহায্য সহযোগীতা অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ব্যক্তিও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহযোগিতা করার নজীর রয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় কর্মহীনদের মাঝেও একইভাবে প্রণোদনা ফান্ড তৈরী করলে দেশও দেশের মানুষ উপকৃত হবে। সরকারের একার পক্ষে করোনার এই মহা দূর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সরকার একা কিছু করতে পারেনা।সরকারের সহযোগী দরকার।
করোনা সংকটে মানুষের পাশে দাড়িয়েছে পুলিশ, চিকিৎসক, প্রশাসন সহ অনেক সামাজিক সংগঠন।পুলিশ সদস্যরা
অসহায়দের খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে লাশ দাফন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ১৮ হাজারের ও বেশী পুলিশ করোনায়
আক্রান্ত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন ১০৩ জন। করোনায় মৃতদেহের কাছে ও স্বজন যায়নি এমন অনেক ঘটনা রয়েছে।
এ সমস্ত ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা মানবিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মৃতদের দাফন ও সৎকার করে সাহসীকতা ও মানবিকতার
দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করেছেন।
লকডাউনে মানুষকে ঘরে রাখতে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। যে কোনো সমস্যায় মানুষ পুলিশকে পাশে
পাচ্ছে, খাদ্য সংকটে খাবার পৌচ্ছে দেয়া, করোনা সন্দেহে যখন প্রতিবেশীরা ও কাছে ভিড়ছেনা সেই মৃতদের পরম মমতায়
দাফন করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পাশাপাশি প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাদের অসাধারণ মানবিক দায়িত্ব পালনের
খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিপোর্ট থেকে জানা যায়। পিরোজপুরের কাউখালি উপজেলার এক নারী করোনায় মারা যান মৃত
নারীর গোছল দিতে আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশী কোন নারীই এগিয়ে আসছিলেননা। সেই খবর উপজেলা নির্বাহী অফিসার খালেদার
কাছে গেলে তিনি একজন নারী এনজিও কর্মীকে নিয়ে সেখানে গিয়ে মৃতনারীর গোছল দেন নিজে।
অসহায়দের পাশে দাড়ানো মানবিক দায়িত্ব
করোনার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে যা অবিশ্বাস্য অমানবিক, এ সমস্ত ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের
কর্মকর্তারা বিরুপ পরিস্থিতিতে ও দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি। করোনা শুরুর দিকে করোনায় মৃতদের কবরস্থানে দাফনে বাধা
দেওয়ার ঘটনা ও ঘটেছিল, নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তারা মৃত ব্যক্তির জানাযা পড়েছেন। অনেক চিকিৎসক আছেন
করোনায় সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেরা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ব্যাংকার সহ আরও অনেক
সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তারা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। গত মে মাস পর্যন্ত
১৩৩ জন ব্যাংকার করোনায় মারা গেছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৬ হাজার।
করোনায় আক্রান্ত অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে তারা মরেও অমর হয়ে থাকবেন। এটা স্বীকার করতেই হবে সরকার মানুষকে
করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা করার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এটাও অনস্বীকার্য প্রণোদনা সহায়তা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের
প্রয়োজনের তুলানায় অতি নগন্য।
একদিকে মানুষের আয় কমছে অন্যদিকে নিত্য পণ্যের দামের উর্ধ্বগতির কারণে মানুষ দিশাহারা, এমতাবস্থায় বাংলাদেশের
মতো উন্নয়নশীল দেশে লকডাউন কার্যকর সমাধান হতে পারেনা। লকডাউনের কথা শুনলেই এদেশের খেটেখাওয়া মানুষের
মধ্যে চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠা ও হতাশা বিরাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ভিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি)মতে
সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করলে লকডাউন এড়াতে এবং করোনা প্রতিরোধে অনেক সহায়তা হবে। অনেক উন্নত দেশ করোনা
ভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ককেই বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মাস্ক
ব্যবহারের হার সম্পর্কে জানা যায়।
সিঙ্গাপুরে মোট জনসংখ্যার ৯২, স্পেনে ৯০, থাইল্যান্ডে ৮৮ হংকং এ ৮৬ জাপানে ৮৬ শতাংশ নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করেন।
এ টু আই ও বেসরকারি গবেষনা সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় বাংলাদেশে এ সংখ্যার হার ৩০ শতাংশ তবে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার
করেন বাংলাদেশের ১২ থেকে ১৩ শতাংশ মানুষ। বর্তমানে সংকটময় পরিস্থিতিতে মাস্ক ব্যবহার সহ সরকারের দেয়া স্বাস্থ্যবিধি
পরিপালন করতে হবে মহান আল্লাহর তায়ালার সাহায্য কামনা করতে হবে। কঠোর লকডাউনের পরিবর্তে কঠোর স্বাস্থ্যবিধির
বাস্তবায়ন করতে হবে।
অসহায়দের পাশে দাড়ানো মানবিক দায়িত্ব
করোনা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে সর্বাত্বক ও সমন্বিত পদক্ষেপের কোন বিকল্প নাই। ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ,
সংস্কৃতিকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাতিমান
সিভিল সোসাইটির নেতৃবৃন্দের এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা দরকার। বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুছ ২৩ জুলাই
টোকিওতে ‘অলিম্পিক লরেল’ পেয়েছেন। তিনি একজন পৃথিবী বিখ্যাত মানুষ দেশ বিদেশে তাঁর অনেক সম্মান ও মর্যাদা
রয়েছে। করোনার এই সংকটকালে দেশের মানুষের দুঃসময়ে এদেশের মানুষ এমন একজন পন্ডিত ও বিশ্বখ্যাত মানুষের কাছ
থেকে অনেক কিছুই আশা করে।
লেখক
ড. মোহাম্মদ আবু তাহের
কলামিষ্ঠ ব্যাংকার ও গবেষক
ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত সংবাদ দেখুন || ভোক্তাকণ্ঠ