ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: পণ্য বা সেবা, লেনদেনের যেকোনো ক্ষেত্রে প্রতারিত হলে অভিযোগ করা যায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। সব ধরনের পণ্য বা সেবার অনিয়ম নিয়েই অভিযোগ করা যায় সেখানে। তবে ভোক্তারা সাধারণত বাছাই করা কিছু বিষয়েই অভিযোগ করেন। আবার যখন যে ধরনের অভিযোগ আসতে থাকে, দেখা যায় সে ধরনের অভিযোগই বেশি বেশি আসে। অন্যান্য বিষয়ের অভিযোগ আসে খুবই সামান্য। এক্ষেত্রে এক সময় মোবাইল অপারেটর এবং রাইড শেয়ারিংয়ের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ আসলেও এখন সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে ই-কমার্স নিয়ে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে ৫৬ হাজারের বেশি। সেসব অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুরুর দিকে ভোক্তাদের অভিযোগের সবচেয়ে বড় প্রবণতাটি ছিল মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে। যেখানে প্যাকেজের নামে প্রতারণা, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা না দেওয়া ও গ্রাহকের অজান্তে টাকা কেটে নেওয়ার অভিযোগ ছিল বেশি।
২০১৭ সালের পর সে ধারায় পরিবর্তন আসে। তখন বেশি অভিযোগ আসত অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের বিরুদ্ধে। এ ধরনের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও তাদের চালকদের ভাড়া বেশি নেওয়াসহ বিভিন্ন অফার ও ছাড়ের প্যাকেজে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে অহরহ।
এখন অভিযোগ বেশি ই-কমার্স শপগুলোর বিরুদ্ধে। সঠিক পণ্য না দেওয়া, প্রতিশ্রুত পণ্য না পাওয়া, রিফান্ড না পাওয়ার মতো অভিযোগই বেশি আসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিগত তিন বছরে নামি-বেনামি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রায় ২০ হাজার অভিযোগ করেছেন ভোক্তারা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এখনো বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে অভিযোগ আসে। তবে তার পরিমাণ ই-কমার্সের অভিযোগের তুলনায় নগন্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দুটি সেবায় অভিযোগ কমার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। ২০১৭ সালে মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটার এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মোবাইল অপারেটরদের বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। এরপর আর রিট আবেদনটির শুনানি হয়নি এখন পর্যন্ত। ফলে সে সময় ১ হাজার ৬০০টির বেশি অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ঝুলে যায়। এরপর আর কোনো মোবাইল অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি। সেজন্য প্রতিকার না পেয়ে অভিযোগে অনিহা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে রাইড শেয়ারিং বাড়লেও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। এখন অ্যাপের থেকেও বেশি চুক্তিতে চলছেন সাধারণ মানুষ। এ কারণে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ কমেছে।
এসব বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যেহেতু আইনি জটিলতায় কারণে মানুষ মোবাইল অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিকার পাচ্ছে না, তাই তারা আর খুব একটা অভিযোগ করছে না। এছাড়া দীর্ঘ সময় ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রমে কিছু অভিযোগ কোম্পনিগুলো সংশোধন করেছে। কিছু ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরেছে, সেটাও সত্য। পাশাপাশি প্রতারিত হতে হতে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে।
এখন ই-কমার্সের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়টা সরকার শক্তভাবে দেখেছে। মানুষও আস্থা হারিয়ে প্রতিকারের জন্য অভিযোগ করেছে। অভিযোগের বিপরীতে অর্থ ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম চলছে।
এমন অবস্থায় দেশে আজ (১৫ মার্চ) পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। সমসাময়িক পেক্ষাপটে এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে ‘ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থায় ন্যায্যতা’।
ভোক্তা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আইন করা হলেও ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়েছিল ১৭৯টি। এর পরের অর্থবছরে (২০১৪-১৫) ২৬৪টি এবং পরের বছর ৬৬২টি অভিযোগ পরে। অভিযোগ বাড়তে থাকে পরের অর্থবছর ২০১৬-১৭ থেকে। ওই সময় ছয় হাজার ১৪০টি অভিযোগ আসে। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ১৯টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাত হাজার ৫১৫টি, ২০১৯-২০ এ ৯ হাজার ১৯৫টি এবং গত অর্থবছরে (২০২০-২১) ১৪ হাজার ৯১০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সে হিসাবে গত অর্থবছর পর্যন্ত মোট অভিযোগের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৮৮৪টি। এরমধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে ৪৪ হাজার ৫৯৭টি।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) অভিযোগ এসেছে ১১ হাজার ৫২৭টি। সবমিলে এ পর্যন্ত মোট অভিযোগ দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ১২৪টিতে। এর মাঝে ৫১ হাজার ৭৫৯টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
এদিকে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না জানাতে পারলেও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮-১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় বিশ হাজারের মতো অভিযোগ এসেছে শুধু ই-কমার্সের বিরুদ্ধে। এগুলো গত অর্থবছর পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আরও বলছেন, ই-কমার্সের এ প্রতারণা বেড়েছে করোনাভাইরাস মহামারিকালে। সেসময় ঘর থেকে না বেরুনোয় প্রচুর মানুষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটা করেছে। সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গজিয়েও ওঠেছে অধিকাংশ ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান। তাদের লোভনীয় নানা অফারে পণ্য কিনতেও মানুষের হিড়িক পড়ে যায়। পরবর্তীতে ইভ্যালি কাণ্ডের পর প্রচুর ক্রেতা প্রতারণার বিষয়ে দ্বারস্থ হয়েছেন ভোক্তা অধিকারের।