ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: রক্তঝরা সংগ্রামের পথ বেয়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে (১৬ ডিসেম্বর) এসেছিল বাংলাদেশের মহান বিজয়। মুক্ত আকাশে উড়েছিল লাল-সবুজের ঝান্ডা। সেই থেকে শুরু। টানা নয় মাসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত সার্বিক অবকাঠামো, ভঙ্গুর অর্থনীতি। কিন্তু এ জাতিকে দাবিয়ে রাখবে কে? সত্যিই দাবিয়ে রাখা যায়নি। বিজয়ের ৫০ বছরে এসে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।
বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানির পালে লেগেছে হাওয়া; সঙ্গে প্রসার ঘটেছে ব্যাংক খাতের। স্বাধীনতার আগে দেশে ১২টি ব্যাংক ছিল। ১৯৭২ সালে এসব ব্যাংককে একীভূত করে ছয়টি সরকারি ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের যাত্রা। বিজয়ের ৫০ বছরে এসে ছয় থেকে ৬০-এর ঘর অতিক্রম করেছে মোট ব্যাংকের সংখ্যা।
শুরুতে কম থাকলেও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছেন। বড় বড় ব্যবসায়ীর পাশাপাশি এ সেবার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন লাখ লাখ প্রান্তিক উদ্যোক্তা। দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেবা। ক্রমেই হাতের মুঠোয় চলে এসেছে খাতটি। কারণ, ঘরে বসেই এখন টাকা স্থানান্তর, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল এবং কেনাকাটার অর্থ পরিশোধসহ অনেক কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এগুলোর সবই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফসল।
১৯৭১ সালে শত্রুমুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’ এ অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে কাজ করত। ঢাকায় তখন ডেপুটি গভর্নরের একটি কার্যালয় ছিল মাত্র। এর অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়ায় একটি করে শাখা কার্যালয় ছিল। সিলেট ও রাজশাহীতে একটি করে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ শাখা কাজ করত। ব্যাংকের গভর্নর, কেন্দ্রীয় পরিচালকমণ্ডলীর দফতর ও কেন্দ্রীয় পরিচালকমণ্ডলীর সদস্যরা করাচি থেকে কাজ করতেন।
ওই সময় করাচিতে একটি সংগঠনও গড়ে উঠেছিল। মুদ্রা ও ব্যাংক-ব্যবসা সম্পর্কিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তৎকালীন করাচি অথবা ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। অধীনস্থ আঞ্চলিক প্রধান কার্যালয় হিসেবে ঢাকার ডেপুটি গভর্নরের কার্যালয় প্রধানত করাচির নির্দেশাবলী মেনে চলত। এ অঞ্চলের স্বার্থরক্ষাকারী কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কার্যত ঢাকার কার্যালয়ের কোনো বক্তব্য থাকত না। তবুও ঢাকার কার্যালয় মাঝেমধ্যে তাদের মূল্যবান মতামত কেন্দ্রীয় পরিচালকমণ্ডলীর দৃষ্টিগোচর করত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ অঞ্চলের অতিশয় ক্ষুদ্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাঠামোকেই সারা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
বিধ্বস্ত অর্থনীতি, মুদ্রা ব্যবস্থার অভাব ও ভগ্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ তখন সামনে। উপস্থিত শ্রম ও যাবতীয় উপকরণকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ চালাবার জন্যে তৎক্ষণাৎ পুনর্গঠিত করতে হয়। অধিকন্তু, এসব করতে আবার আইনের সম্মতির প্রয়োজন ছিল।
বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে যথাসময়ে নজর দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক (অস্থায়ী) আদেশ’ নামক রাষ্ট্রপতির একটি আদেশ জারি হয়। ওই আদেশ কার্যত ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল থেকে কার্যকর করা হয়। সরকার এরপরই একজন গভর্নর নিয়োগ দেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের গভর্নর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার ভার হাতে নেন। ১৯৭১ সালের অস্থায়ী আদেশ পরবর্তীকালে তুলে নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর নতুন আর একটি ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ’ জারি করা হয়। ওই আদেশের ৪০নং ধারার ২নং উপধারা অনুযায়ী যাত্রা শুরু হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। শূন্য থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বেসরকারি খাতে বাংলাদেশে প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। ওই বছর ১২ এপ্রিল আরব-বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংক লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী এক দশকে দেশে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়ায় আটটি। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পূবালী ও উত্তরা ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। নতুন করে গঠন করা হয় ইসলামি ব্যাংক, ইউসিবি, ন্যাশনাল ব্যাংক, দি সিটি ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (আইএফআইসি) লিমিটেড।
১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ডাচ-বাংলা, ইস্টার্ন, এক্সিম, আল আরাফা, সাউথইস্ট, প্রাইম, প্রিমিয়ারসহ মেট ২২টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসে। ২০১২ সাল থেকে আরও ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এসব ব্যাংকের মধ্যে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছয়টি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালিকানায় দেওয়া হয় তিনটি ব্যাংক। দেশীয় উদ্যোক্তাদের পরিচালনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো- মধুমতি, মিডল্যান্ড, ইউনিয়ন, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, মেঘনা ও পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। প্রবাসীদের মালিকানায় অনুমোদন পায় এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। নতুন ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে বিজিবির সীমান্ত ব্যাংক, পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। সিটিজেনস ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত এর কার্যক্রম শুরু হয়নি।
বর্তমানে দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ছয়টি, বেসরকারি ব্যাংক ৪৩টি, বিশেষায়িত ব্যাংক তিনটি এবং নয়টি বিদেশী ব্যাংক রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১০টি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক। এছাড়া বেশকিছু ব্যাংক তাদের শাখা ও উইন্ডোর মাধ্যমে শরীয়াহ ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে।
স্বাধীনের পর দেশে ব্যাংকের মোট ১১৯১টি শাখা ছিল। এখন সারা দেশে ১০ হাজার ৮২৬টি শাখার মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে ব্যাংক খাত। দিন দিন এর পরিধি বেড়েই চলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অক্টোবর পর্যন্ত গ্রাহকের আমানত ১৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকের অবদান
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পথে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। নানা সংকটের মধ্যেও এ অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রেখেছে ব্যাংক খাত। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো মিলে দেশের শিল্পায়নে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব থাকলেও নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে খাতটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটছে। নীতিগত পরিবর্তনের ফলে অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে। এগুলো মোকাবিলা করেই এগোতে হচ্ছে খাতটিকে।
দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পথে ব্যাংক খাত নিবিড়ভাবে কাজ করছে। শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে না। সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে (সিএসআর) ব্যাংকগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার। বাংলাদেশের মধ্যে এখন সফল একটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে। তাদের সাফল্য অন্যের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। সফল এসব উদ্যোক্তার সাফল্যগাথা সবার সামনে তুলে ধরা দরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাত চলে আস্থার ওপর। এতে যেন সংকট তৈরি না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের স্বার্থে এ খাতের ওপর জনগণের আস্থার সম্পর্কে যেন কোনো ধরনের চিড় না ধরে, সেজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ খাতে যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে।