ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌর বিদ্যুৎ উন্নয়ন মডেল এবং সৌর বিদ্যুতের উন্নতির জন্য মডেলটির প্রচার’ শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁও এ ইউজিসি ভবনে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর প্রধান অতিথি হিসেবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল বিভাগের ডিন, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও প্রকল্প প্রধান অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির ছাত্তার এবং কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ওপেক্স মডেলে রুফটপ ও গ্রাউন্ডে অব্যবহৃত পরিসরে সৌর বিদ্যুৎ উন্নয়ন’ প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন নোভেলটি এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রজেক্ট কনসাটেন্ট প্রকৌশলী মো. ইনতেখাব আলম। ‘অফ-গ্রীড/অন-গ্রীড ডিসি/এসি সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট (সিস্টেম) পার্ফরমেন্ট স্ট্যাডি’ শীর্ষক প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয়।
এছাড়া, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এনার্জি অডিট প্রশিক্ষণ’ শীর্ষক প্রেজেন্টেশনটি উপস্থাপন করেন প্রজেক্ট ফেলো, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক তাসমিয়া বাতেন।
‘পরিবেশ সুরক্ষা ও সৌর বিদ্যুৎ উন্নয়নে সামাজিক আন্দোলন: প্রেক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কো-অর্ডিনেটর (রিসার্চ) প্রকৌশলী শুভ কিবরিয়া।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আমাদের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিদ্যুৎ চাই। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা কুইক রেন্টালে শিফট করি। এই খাতে সরকারের অনেক খরচ হয়েছে। কিন্তু তখন এছাড়া আর কিছু করার ছিল না। কুইক রেন্টালে গিয়েছে বলেই আমরা আজ বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে এখন আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তিতে যেতে হবে। সরকারি হিসেবে অনুসারে- আমরা আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ রিনিউএ্যাবল-এনার্জিতে যাব। ৪০ শতাংশ রিনিউএ্যাবল-এনার্জিতে যেতে হলে এখন থেকে পরিকল্পনা করে আমাদের ফুয়েলের খরচ কমাতে হবে। সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃত অর্থে রিনিউএ্যাবল-এনার্জি যে পরিস্থিতে ব্যবহার হচ্ছে এভাবে চললে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ রিনিউএ্যাবল-এনার্জিতে যাওয়া সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘আজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্বালানি খাতের বাজেট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ খাতে খরচ কমাতে সপ্তাহে একদিন অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। এই মুহুর্তে আমাদের উচিত রিনিউএ্যাবল-এনার্জি নিয়ে রিসার্চ করা। আমরা বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্টে ইনভেস্ট করেছি। এটা খুব বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের মতো দেশ এই চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করেছে এটা খুব ভালো। এটা আমাদের আত্মবিশ্বাসের কারণে সম্ভব হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সৌর বিদ্যুৎ একটি গ্রীন এনার্জি। এটাতে খরচও কম। যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাদের মধ্যে যারা এটা নিয়ে কাজ করেছেন তারা হয়তো এটা সম্পর্কে জানেন। এবং যারা এটা নিয়ে এখনও কাজ করেননি তাদের জন্য আজকের আলোচনা খুবই গুরুত্ব বহন করবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সৌর বিদ্যুৎ ডেভেলপমেন্টের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনো খরচ বহন করতে হবে না।’
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আপনারা স্মার্ট হলে, আপনারা যদি এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন তাহলে সোলার প্যানেল বা সোলার সিস্টেম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যারা এটা প্রতিস্থাপন করতে যাবেন তাদের সঙ্গে আপনি কথা বলে যাচাই বাছাই করে নিতে পারবেন। আপনার স্বার্থ ঠিক রেখে আপনি চুক্তি করতে পারবেন। আপনাদের এই প্রজেক্ট সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করা, আপনাদের সক্ষমতা বোঝানো এবং শিক্ষার্থীরা যাতে এ কাজে যুক্ত থাকে সে জন্য আজকের আমাদের এই আয়োজন।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির ছাত্তার বলেন, ‘প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন হলে প্রযুক্তির প্রসার ঘটবে। নতুন নতুন প্রযুক্তির নতুন দ্বার উন্মুচন করবে। সবদিক থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ভালো হবে। আমাদের সকলের এই পথে যেতে হবে। এটা সকলের জন্য সাশ্রয়ী হবে।’
ইউজিসি’র সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সৌর বিদ্যুৎ নিয়ে কাজ শুরু করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। যেখানে বিদ্যুৎ সেখানেই উন্নয়ন। সৌর বিদ্যুতের নেগেটিভ কিছু নেই।’
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘একদিকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, কয়লা আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি, অন্যদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট। তাছাড়া ভর্তুকি প্রদানে সরকারের অপারগতার কারণে আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধি সমন্বয় ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানির অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত। এ অবস্থায় ভোক্তারা একদিকে জ্বালানি সুবিচার (এনার্জি জাস্টিস) বঞ্চিত হয় অন্যদিকে জ্বালানি নিরাপত্তায় জ্বালানি অধিকার হারায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। সৌর বিদ্যুৎ এখন বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০০৮ থেকে ২০২১ সালে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ হতে হতো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। কিন্তু বাস্তবতা এক শতাংশ নয়। প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুৎ অনধিক ৭.৫০ টাকা OPEX মডেলে উৎপাদন করা সম্ভব। যদি তা হতো তাহলে পর্যাপ্ত বৈদেশিক ঋণ ও মুদ্রা সাশ্রয় হতো। স্বল্পমূল্যের নিজস্ব গ্যাস গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত মোট জালানির প্রায় ৬০ শতাংশ। তা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হার গড়ে প্রায় ১২ টাকা। ভোক্তা পর্যায়ে সে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় হার কম-বেশি করে প্রায় ১৪ টাকা। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে এখন কয়লা, এলএনজি ও ফার্নেস ওয়েল আমদানি ব্যহত এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক অংশে অব্যবহৃত। এ অবস্থায় ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এখন নিয়ন্ত্রণহীন।’
শামসুল আলম বলেন, ‘জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত হতে হলে জ্বালানির অভাবে যে পরিমাণ উৎপাদন সঞ্চালন বিতরণ পরিবহন ক্ষমতা ব্যবহার হয় না সেই অনুপাতে ক্যাপাসিটি/অবচয়ের চার্জ ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ কিংবা প্রাথমিক জ্বালানির মূল্য হারে সমন্বয় করা যায় না। আবার যে পরিমাণ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার ধরে মূল্য হার নির্ধারিত হয়, তা অপেক্ষা যতটা কম ব্যবহার হয্ সেই অনুপাতে ক্যাপাসিট/অবচয় চার্জ সমন্বয় করে বিদ্যুৎ বিল কমাতে হয়। তাহলে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণহীন হতো না এবং বিদ্যুৎ ও ডলার সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ হতো অন্যতম নিয়মক। তাই জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উন্নয়নে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিভাবে অবদান রাখতে পারে তারই একটি রূপরেখা উপস্থাপিত হলো।’