ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ উদ্যোগে যখন (২০১২) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, তখন বলা হয়েছিল ইউনিটপ্রতি খরচ দাঁড়াবে সাড়ে সাত থেকে আট টাকা। কিন্তু রামপাল উৎপাদনে আসার পর এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১৪ টাকার বেশি।
কয়লাবিদ্যুতের এই দর এখন ফার্নেস তেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের কাছাকাছি। বাড়তি ব্যয়ের কারণ দুটি- এক. বিশ্ব বাজারে কয়লার দাম ও মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া। দুই. বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির সময় কয়লার মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া ‘যথাযথ’ না হওয়া।
কয়লাবিদ্যুৎ পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সরকার এই বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকেছিল সাশ্রয়ী দামের কথা বলে। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু রামপাল নয়, পটুয়াখালীর পায়রায় বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত পায়রা কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও বাড়তি দাম পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে সরকার এখন ‘কিছু একটা’ করার কথা ভাবছে। কয়লার দাম নির্ধারণের কৌশল ঠিক করতে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে কাজ করছে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি।
গত ২৩ জানুয়ারি গঠন করা এই কমিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানির চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট আমদানি প্রক্রিয়া ও সরবরাহপদ্ধতি পর্যালোচনা করছে। কয়লা সরবরাহ, ঋণপত্র খোলা ও আমদানির অনুমতি বিষয়ে সুপারিশ করবে তারা। গত সোমবার দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠক করেছে এ কমিটি। বৈঠকে অংশ নেওয়া তিনজন কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে কয়লা কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। অন্যান্য দেশ কীভাবে কয়লা কেনে, সেটিও দেখা হচ্ছে। আরও বৈঠক করা হবে। এরপর কয়লা কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সুপারিশ বা মতামত জানাবে কমিটি।
কমিটি গঠনের কারণ জানতে চাইলে বিদ্যুৎ-সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কয়লা আমদানি নিয়ে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। বিদ্যুৎ বিভাগ গঠিত কমিটি এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে এবং করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করবে। এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে যে দাম পড়ে তা ধরলে গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বেশি। বরং কয়লা থেকে কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। বিশ্ববাজারে কয়লার দাম কমছে। এটি আরও কমবে।’
অবশ্য আগে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, তেলভিত্তিক বিদ্যুতের বদলে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালু হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, খরচ তো কমছেই না বরং মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। জানুয়ারি মাসে খুচরায় দুই দফায় ১০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম।
সব মিলিয়ে গত ১৪ বছরে খুচরায় বিদ্যুতের দাম ১২ দফা বেড়েছে। আর পাইকারিতে বেড়েছে ১১ বার।
গ্যাস থেকে কয়লায় জোর
২০০৫ সালে করা বিদ্যুৎ খাতের প্রথম মহাপরিকল্পনা ছিল গ্যাসনির্ভর। এর পর ২০১০ সালের মহাপরিকল্পনায় কয়লার ওপর জোর দেওয়া হয়। ওই মহাপরিকল্পনা ধরে বড় কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পায়রা ও রামপাল, ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চট্টগ্রামে এস আলমের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র। বরিশালের বরগুনায় ৩০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠার পর্যায়ে রয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেশে বিতর্ক ও আন্দোলন হয়েছে। পরিবেশবাদীরা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে দাবি করেছেন। জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বলে উল্লেখ করে বলা হয়, এগুলো পরিবেশদূষণ কম করবে। যদিও কয়লাবিদ্যুৎ থেকে সরে আসতে অনুমোদন দেওয়ার পরও সরকার ২০২১ সালের জুনে ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে।
নতুন কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের মধ্যে ২০২০ সালে প্রথম উৎপাদনে আসে পায়রা। গত ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসে রামপাল। ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য প্রতিষ্ঠিত আদানির ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে শিগগিরই।
সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। যার মধ্যে কয়লাবিদ্যুৎ ১২ শতাংশ। অবশ্য এ হিসাবে এখনো আদানি, এস আলম ও বরগুনার বিদ্যুৎকেন্দ্র ধরা হয়নি।
ব্যয় কত দাঁড়াচ্ছে
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব বলছে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) কয়লা থেকে বিদ্যুৎ কিনতে (প্রতি ইউনিট) গড়ে পিডিবি খরচ করেছে ১৩ টাকা ৪০ পয়সা। তবে আমদানি করা কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৪ টাকা ৭৯ পয়সা। আর ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হয়েছে ১৬ টাকা ৮৬ পয়সা। বেসরকারি খাতের (আইপিপি) ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় আরও কম।
ফলে দেখা যাচ্ছে কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন আর সস্তা নয়। দাম ফার্নেস তেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের কাছাকাছি।
কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ডিসেম্বরে একটি পর্যালোচনা করে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল। তাদের হিসাবেও দেখা যায়, চুক্তির সময় যে দামে বিদ্যুৎ কেনার আশা ছিল, তার চেয়ে এখন প্রায় দ্বিগুণ দাম পড়ছে। যেমন পায়রা থেকে কেনা বিদ্যুতের দর পড়ার কথা ছিল ইউনিটপ্রতি সাড়ে ৬ টাকার মতো। এখন কয়লার দর টনপ্রতি ২৪৫ ডলার ধরা হলে বিদ্যুতের দাম ১৮ টাকা পড়তে পারে।
সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লায় জোর দেওয়ার সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি বলে মনে করেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও বিদ্যুৎ খাত বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘ফার্নেস তেলের চেয়ে অর্ধেকের কম হওয়ার কথা কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ। কিন্তু অযৌক্তিক ভাবে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ধরে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সস্তার কয়লা বিদ্যুৎ মুনাফা হয়ে বিনিয়োগকারীদের পকেটে চলে যাচ্ছে। এটা রামপাল, পায়রা, আদানি, সব ক্ষেত্রেই।’
পিডিবি সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, পায়রা থেকে গত অর্থবছরে সংস্থাটি বিদ্যুৎ কিনেছে ইউনিটপ্রতি ১৪ টাকা ৭৯ পয়সায়। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া গিয়েছিল ছয় টাকায়। আদানি গ্রুপের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ সাড়ে আট থেকে নয় টাকায় পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল। এখন এটি ১৫ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, আদানি কয়লার দাম বেশি চাচ্ছে। এ নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) গত মাসের একটি প্রতিবেদন বলছে, গত জুলাই মাসে দেশে প্রতি টন কয়লা আমদানি হয়েছে গড়ে ২০৬ মার্কিন ডলার দরে। এর পর থেকে তা কমে অক্টোবরে গড়ে ১৩৪ ডলার দাঁড়ায়। নভেম্বরে দাম একটু বেড়েছে, টনপ্রতি দাঁড়িয়েছে ১৫০ ডলারের কিছু বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডিসেম্বর কয়লা আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে টনপ্রতি ১১৫ ডলার ধরে। জানুয়ারিতে দর পড়েছে ১১৯ ডলার। অবশ্য কয়লার কমতি দামের মধ্যেও বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।
অভিযোগ আছে, রামপাল ও বরগুনার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দাম বেশি ধরা হচ্ছে। এ নিয়ে গত মাসে আপত্তি জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কয়লা আমদানিতে বিঘ্ন ঘটে। এরপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকে এক মাস।
জানতে চাইলে সাবেক বিদ্যুৎ-সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘সমস্যার মূলে আসলে ২০১০ সালে করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন। এই আইনের আওতায় উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। উন্মুক্ত দরপত্র হলে প্রতিযোগিতা হতো, কেউ বেশি দাম চাইলে অন্যদের প্রস্তাব দেখে তা বোঝা যেত, সে অনুযায়ী দর-কষাকষিও করা যেত। উন্মুক্ত দরপত্র না হওয়ায় সেটা করা যাচ্ছে না। আবার এসব চুক্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতির উপাদানও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের বাড়তি দাম দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ত্রুটিপূর্ণ চুক্তির মাশুল জনগণকেই দিতে হয়।’