ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: জ্বালানি সংকটে দেশে বন্ধ করে দেওয়া ডিজেল চালিত ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি মাসে ১৭.২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার বা ১৬১ কোটি ২৮ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ৯৩.৫০ টাকা হিসেবে) ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোকে দিতে হবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিউবো)।
অন্যদিকে, ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন করলে প্রতিদিন ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে খরচ হবে ২২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ চার লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, বন্ধ রেখে ভর্তুকি না দিয়ে এই চুক্তি বাতিল করা প্রয়োজন। কারণ এই চুক্তিতে ভোক্তাদের কোন উপকার নেই।
ডিজেলে ঘাটতি কমাতে গত সোমবার (১৮ জুলাই) থেকে কেন্দ্রগুলো বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। বন্ধ করা ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো- কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ের ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ওরাহাটির ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ব্রাক্ষ্মণগাঁওয়ের ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দাউদকান্দির ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নোয়াপাড়ার ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাঘাবাড়ির ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এ বিষয়ে বিউবোর অর্থ পরিদপ্তরের পরিচালক মো. নাছরুল হক ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে। তাদের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি রয়েছে, চার বছর হয়েছে। বাকি সময়ের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখলেও চুক্তি অনুযায়ী তাদের ভর্তুকি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।’
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘এ সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনারই দরকার নেই। যেহেতু আমাদের লোডশেডিং চলছে। আর আমাদের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতাও বেশি। তাই এই বিদ্যুৎ কেনা এখন বৈধ নয়, এটা অবৈধ ভাবে কেনা হচ্ছে। সুতরাং (রাষ্ট্রের স্বার্থে) ক্যাপাসিটি চার্জ না দিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করে চুক্তি বাতিল করা অতি প্রয়োজন।’
বিউবোর সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) দেওয়ান সামিনা বানু ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী তাদের ভর্তুকি দিতে হবে। তবে চুক্তি বাতিলের সুযোগ রয়েছে কি-না এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।’
তথ্যমতে, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত তিন বছর বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গেছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট, তবে সরকারের দাবি ২৫ হাজার মেগাওয়াট (ক্যাপটিভসহ)। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বাড়তি সক্ষমতা সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে।
উৎপাদন ক্ষমতা অনুসারে বিদ্যুৎ নিতে না পারায় দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রাকে প্রতি মাসে বড় অঙ্কের অর্থ দিতে হচ্ছে পিডিবিকে। আর যুক্তি হিসাবে বলা হচ্ছে, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্যে বিদ্যুৎ লাইনের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশের সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা গ্যাসভিত্তিক, মোট ক্ষমতার ৫২ শতাংশ। এর বাইরে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের ক্ষমতা ২৭, ডিজেলের ৬ ও কয়লার ৮ শতাংশ। বাকিটা জলবিদ্যুৎ ও আমদানির বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছরের মধ্যে দেশে আরও তিনটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদের রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মেয়াদ বার বার বাড়ানো হচ্ছে। ফলে সামনে ক্যাপাসিটি মাশুল আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। যদিও এখন সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় সাশ্রয়ে রেশনিং শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে সামিট গ্রুপকে। এছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপ, বাংলা ট্র্যাক, চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি), ওরিয়ন গ্রুপ, ডরিন পাওয়ারসহ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানির পকেটে ক্যাপাসিটি চার্জের বিপুল অর্থ গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের ৮৩ কেন্দ্রের জন্য দিতে হয় ১৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের মধ্যে ৬১টি ছোট-বড় আইপিপি কেন্দ্রের মালিকরা পান প্রায় নয় হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের পকেটে গেছে এক হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না কিনেও প্রায় দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকা দিতে হয়। পাবলিক খাতের ১৫টি সরকারি কোম্পানি চার হাজার ২২২ কোটি টাকা পায়।
গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ না কিনেও সরকারের ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মাশুল দিতে হয়। বেসরকারি খাতের ৮১টি কেন্দ্রের পেছনে খরচ হয় ১৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬২টি আইপিপি ও সিআইপিপি কেন্দ্রের মালিক পান ১১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মালিক বিদ্যুৎ না বিক্রি করেও পান এক হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ভারত থেকে আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় এক হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। পাবলিক খাতের সরকারি কোম্পানির পেছনে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় চার হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
সমকালের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুন ‘২১ থেকে মার্চ ‘২২) বিদ্যুৎ না কিনেও সরকারের খরচ ১৬ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ৭৩টি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক পেয়েছেন ১২ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬১ আইপিপি উদ্যোক্তা নিয়েছেন ১১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। ১২ রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল উদ্যোক্তারা বিদ্যুৎ না বিক্রি করেই পেয়েছেন ৬৭৮ কোটি টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিতে হয়েছে ৮৬৯ কোটি টাকা।