নিজস্ব প্রতিবেদক: ডিজেল ও কেরোসিনসহ জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে প্রশাসনিক প্রতিকার না পেলে উচ্চ আদালতের দারস্থ হবে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সোমবার দুপুরে ক্যাবের উদ্যোগে ‘জ্বালানি তেলের মূল্য আবারও অবৈধ উপায়ে বৃদ্ধি না করার দাবি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়ালি সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ক্যাবের জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম।
সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনে ধারণপত্র উপস্থাপন করেন তিনি।
এছাড়াও, বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বদরূল ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ, ক্যাবের ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ূন কবীর ভূঁইয়া।
জ্বালানির দাম বাড়ানো হলে ক্যাব কি করবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা নাগরিক সমাজ। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করতে পারি না। আমরা বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা এবং আলোড়ন তৈরি করার চেষ্টা করি। যা ধারাবাহিক ভাবে করে যাচ্ছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রতিকারও পেয়েছি। জ্বালানির ক্ষেত্রেও প্রথমে আমরা প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অবহিত করবো। যদি তাতে কাজ না হয় তাহলে আমাদের উচ্চ আদালতে যাবার সুযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিপিসি, বিইআরসি, পেট্রোবাংলাসহ এসব কোম্পানির পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকায় জ্বালানি খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কাছ থেকে এসব কোম্পানি মুক্ত করা আমাদের এখন মৌলিক দায়িত্ব। এসব কোম্পানি মুক্ত করা ছাড়া কোন ভাবেই এই খাতে ভোক্তাদের জ্বালানি অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শামসুল আলম বলেন, ‘আমরাতো জ্বালানির দাম বাড়ানো বা কমানোর বিষয়ে বলছি না। জ্বালানি বিভাগ এবং বিপিসি অবৈধ ভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াচ্ছে এটাকে মানছি না। আমরা বৈধ প্রক্রিয়ায় জ্বালানির দাম বাড়ানোর গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ বৈধ ভাবে বাড়ালে তাদের প্রস্তাবটি বিইআরসির কাছে আনতে হবে এবং বিইআরসিতে আনলে আমরা ভোক্তারা গণশুনানির মাধ্যমে বিপিসির প্রস্তাবে কোনটি যৌক্তিক-অযৌক্তিক সেটা পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মতামত দিতে পারবো। কিন্তু তারা বিইআরসিতে না এসে একতরফা ভাবে তাদের ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে, এই যুক্তিতে দাম বাড়াতে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এলপিজির দাম একতরফা ভাবে বাড়াতো। কিন্তু আমরা হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে সেটা বাতিল করেছি। এখন দাম বিইআরসির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এতো বড় একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও তারা বিইআরসির গণশুনানি বাদ দিয়ে, ভোক্তাদেরকে বাদ দিয়ে অবৈধ ভাবে একতরফা দাম চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা বড় ধরনের আইনের বিপর্যয় এবং আইন থাকা সত্ত্বেও আইন না মেনে রাষ্ট্রকে এ রকম একটি চরিত্রে জনগণের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এটা ভয়ংকর রকম একটি অসভ্য দৃষ্টান্ত বলতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ধারণপত্র উপস্থাপনের সময় অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিপিসি’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সর্বমহলের। ক্যাব দীর্ঘদিন ধরে বিপিসি’র আয়-ব্যয়ের হিসাব আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিরপেক্ষ অডিট করানোর দাবি করে আসছে। এ দাবি দাতা সংস্থারও। বিইআরসি আইনের ২২ ও ৩৪ ধারা মতে এলপিজিসহ সকল পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য তথা ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন, ফার্নেসওয়েল ইত্যাদির মূল্য নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসি’র। ২৭ ধারা মতে বিপিসি বিইআরসি’র লাইসেন্সি। ৩৪(৬) ধারা মতে উক্ত যেকোনো জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি/পরিবর্তনের প্রস্তাব লাইসেন্সি হিসেবে বিপিসি’কে বিইআরসি’র নিকট পেশ করতে হবে এবং ৩৪(৪) ধারা মতে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে শুনানি দেওয়ার পর বিইআরসি মূল্য নির্ধারণ করবে। বিইআরসি’র আইনমতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হয়। উচ্চ আদালতের আদেশ হওয়ায় এলপিজি’র মূল্য এখন বিইআরসি নির্ধারণ করে। তাতে দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে লাইসেন্সিরা সিলিন্ডার প্রতি কমপক্ষে গড়ে দেড় শত টাকা বেশি নিয়েছে। ভাবা যায়, বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভোক্তাদের নিকট থেকে কত কোটি টাকা লুণ্ঠন করা হয়েছে!’
তিনি বলেন, ‘পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য তথা তরল জ্বালানির মূল্য বিইআরসি কর্তৃক শুনানির ভিত্তিতে নির্ধারিত হলে জানা যেত লিটার প্রতি বাড়তি কত টাকা বিপিসি নিচ্ছে এবং ৪৩ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে কত কোটি টাকা ইতোমধ্যে নিয়েছে। আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ে লাইসেন্সিরা গ্যাসে ১১৭ শতাংশ এবং বিদ্যুতে ৬৯ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে। কিন্তু গণশুনানিতে প্রতিয়মান হয়, গ্যাসে ঘাটতি ১৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬২ দশ্মিক ১৩ শতাংশ। অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এমন ব্যয় যুক্ত না করা হলে গ্যাসে ভর্তুকি হ্রাস পায় এবং মূল্যবৃদ্ধি হয় না। আবার অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বিদ্যুতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সে ব্যয় যুক্ত না হলে বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি থাকে না এবং মূল্যবৃদ্ধি নয়, কমে। জ্বালানি তেলকে যদি চুরি এবং অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়মুক্ত করতে হয়, তাহলে দরকার বিইআরসি আইনমতে মূল্য নির্ধারণ করা এবং সেই সঙ্গে লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ড তথা প্রশাসনকে আমলামুক্ত করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের তিন কর্তৃপক্ষীয়/নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বিইআরসি ও বিপিসি আইন উপেক্ষা ও লংঘন এবং বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে বেপরোয়া। ফলে জ্বালানি খাতে আইনের শাসন অচল। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তা অধিকার ভয়ানক ভাবে বিপর্যস্ত। এমন দৃষ্টান্ত কোন সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। তাই আমরা এমন পরিস্থিতির অতি দ্রুত পরিবর্তন চাই।’
এ সময় ক্যাবের পক্ষ থেকে চারটি দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিসমূহ হলো-
– জ্বালানি বিভাগ/বিপিসি’র পরিবর্তে ডিজেল, ফার্নেসওয়েল এবং কেরোসিনের মূল্য পবিবর্তন/সমন্বয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের শুনানির ভিত্তিতে বৈধ ভাবে বিইআরসি কর্তৃক নিশ্চিত করা।
– কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল দ্বারা বিপিসি’র আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তরল জ্বালানি ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়াদি নিবিড় পর্যালোচনা করানো।
– জ্বালানি খাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সকল লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ড তথা প্রশাসন থেকে জ্বালানি বিভাগসহ সকল মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকর্তাদের অবমুক্ত করা। এসব কর্মকর্তা কর্তৃক লাইসেন্সিদের নিকট থেকে গৃহীত আর্থিক সুবিধাদি অবৈধ বিধায় গৃহীত সমূদয় অর্থ তাদের নিকট থেকে আদায় করা।
– বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য নির্ধারণের অপরাধে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট সচিব/সিনিয়র সচিব (ভূতপূর্বসহ) এবং বিপিসি’র চেয়ারম্যানকে (ভূতপূর্বসহ) বিইআরসি আইনের ৪২ ধারামতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আওতায় আনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বদরূল ইমাম ভোক্তাদের জন্য ক্যাবের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘ক্যাবের কয়েকটি বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট এবং এর মধ্যে দুটো বিষয় আমার নজর কেড়েছে। এর মধ্যে একটি হলো অবৈধ, আরেকটি হলো লুণ্ঠন। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে এবং এর অবৈধ প্রয়োগ প্রতিহত করে৷ কিন্তু রাষ্ট্র কিভাবে অবৈধ কাজ করে।
‘আরেকটি বিষয় হলো, রাষ্ট্র যদি লুণ্ঠনের হাত থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেয়, তাহলে রাষ্ট্র কিভাবে লুণ্ঠন করে। ক্যাবের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র অবৈধ কাজ করছে এবং বিইআরসির দ্বারা মূল্য নির্ধারণের যে বিধি রয়েছে তা অমান্য করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘লুণ্ঠনের বিষয়টি আমরা আগে থেকেই জানি। যেমন ধরেন যারা পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করেন। তারা জানেন, যে পরিমাণ গ্যাস আমরা ব্যাবহার করি, তার থেকে বাড়তি মূল্য আমাদের কাছ থেকে নেয়া হয়। এটা একটা লুণ্ঠনের বিষয়, যা ক্যাব প্রথম এই লুণ্ঠনের বিষয়টি তুলে ধরে। বিপিসি যে অনিয়ম করে তার প্রমাণ হলো, ক্যাবের উদ্যোগের পর বিপিসি ৭৭ কিউবিক ঘন মিটার থেকে কমিয়ে ৬০ কিউবিক ঘন মিটারে নিয়ে এসেছে। ক্যাব যে অভিযোগ করেছে তার প্রমাণ রয়েছে। তাই বিপিসির বিরুদ্ধে যে লুণ্ঠন ও অবৈধ কাজের অভিযোগ রয়েছে তা তারা করে কি না, গণমাধ্যমকে বিপিসির কাছে সেই প্রশ্ন করা দরকার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘কেরোসিন, ফার্সেনওয়েল, গ্যাস, পেট্রোলিয়ামের দামের ওপর অন্যান্য সকল পণ্যের দাম নির্ভর করে। এসব জ্বালানি পরিবহন সেক্টরে ব্যবহার হওয়ায় বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।’
সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যদি আইন প্রণয়ন করে, আইন না বদলিয়ে, আইন ভঙ্গ করা হয়, তাহলে আগে একটা এনডেমনিটি আইন তৈরি করেন। যে সরকার যা খুশি তাই করতে পারবে। এটাই সরকারের আইন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনডেমনিটি আইন সব সময় একটি অসভ্য দেশের আইন। এক সময় আওয়ামী লীগ সরকার এই আইনকে কালো আইন বলেছে। এখন জ্বালানি খাতে এমন আইন করে তারা যা খুশি তাই করবেন?’
ক্যাবের ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘বিপিসি, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আদালত রায় দিয়েছেন। কিন্তু তারা সেই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। বিচারালয় বিচারের রায় দিতে পারেন। কিন্তু প্রয়োগ করার দায়িত্ব সরকারের এবং সরকারের মেশিনারিজগুলোর। কিন্তু সরকারের এই মেশিনারাজিগুলো যখন সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন না করে তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দাঁড়ায় সংসদের।’
তিনি বলেন, ‘বিপিসি এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাই, তারা যে কাজগুলো করছে সেগুলো আইন সম্মত কি না? বা আইনের ব্যত্যয় করছেন কি না? বা আপনার বিরুদ্ধে আদালত যে রায়টি দিয়েছে সে রায়ের বিরুদ্ধে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন কেন? সে ক্ষমতা কি আপনাকে দেওয়া আছে? তাহলে আপনারা জানিয়ে দেন যে, জ্বালানি খাতে আমরা যা সিদ্ধান্ত নেব, বাংলাদেশের জনগণকে তা মাথা পেতে নিতে হবে।’
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ূন কবীর ভূঁইয়া বলেন, ‘ভোক্তারা এখন এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছে। পণ্যের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। এর পরে যদি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পায় তাহলে ভোক্তাদের আরও যাওয়ার কোন জায়গা থাকবে না। এ জন্য সরকারের কাছে ক্যাবের পক্ষ থেকে আমাদের অনুরোধ কোন অবস্থাতেই যেন এ সময় জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা না হয়।’