নিজস্ব প্রতিবেদক: কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেছেন, ‘সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জ্বালানি তেলের মূল্য অবৈধ উপায়ে আবারও বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং অতিসত্বর সে সিদ্ধান্ত গেজেটে প্রকাশ করতে যাচ্ছে। দিনে ৯০ কোটি টাকা ভতুর্কি কমানোর অজুহাতে তারা পরিবহনসহ ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় শত শত কোটি টাকা বাড়াবে। ফলে ভোক্তারা এখন অতিমাত্রায় আতংকিত এবং দিশেহারা।’
সোমবার ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ক্যাবের জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি বলেন, ‘বিপিসি’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সর্বমহলের। ক্যাব দীর্ঘদিন ধরে বিপিসি’র আয়-ব্যয়ের হিসাব আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিরপেক্ষ অডিট করানোর দাবি করে আসছে। এ দাবি দাতা সংস্থারও। বিইআরসি আইনের ২২ ও ৩৪ ধারা মতে এলপিজিসহ সকল পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য তথা ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন, ফার্নেসওয়েল ইত্যাদির মূল্য নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসি’র। ২৭ ধারা মতে বিপিসি বিইআরসি’র লাইসেন্সি। ৩৪(৬) ধারা মতে উক্ত যেকোনো জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি/পরিবর্তনের প্রস্তাব লাইসেন্সি হিসেবে বিপিসি’কে বিইআরসি’র নিকট পেশ করতে হবে এবং ৩৪(৪) ধারা মতে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে শুনানি দেওয়ার পর বিইআরসি মূল্য নির্ধারণ করবে। বিইআরসি’র আইন মতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হয়। উচ্চ আদালতের আদেশ হওয়ায় এলপিজি’র মূল্য এখন বিইআরসি নির্ধারণ করে। তাতে দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে লাইসেন্সিরা সিলিন্ডার প্রতি কমপক্ষে গড়ে দেড় শত টাকা বেশি নিয়েছে। ভাবা যায়, বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভোক্তাদের নিকট থেকে কত কোটি টাকা লুণ্ঠন করা হয়েছে!’
তিনি বলেন, ‘পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য তথা তরল জ্বালানির মূল্য বিইআরসি কর্তৃক শুনানির ভিত্তিতে নির্ধারিত হলে জানা যেত লিটার প্রতি বাড়তি কত টাকা বিপিসি নিচ্ছে এবং ৪৩ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে কত কোটি টাকা ইতোমধ্যে নিয়েছে। আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ে লাইসেন্সিরা গ্যাসে ১১৭ শতাংশ এবং বিদ্যুতে ৬৯ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে। কিন্তু গণশুনানিতে প্রতিয়মান হয়, গ্যাসে ঘাটতি ১৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬২ দশ্মিক ১৩ শতাংশ। অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এমন ব্যয় যুক্ত না করা হলে গ্যাসে ভর্তুকি হ্রাস পায় এবং মূল্যবৃদ্ধি হয় না। আবার অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বিদ্যুতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সে ব্যয় যুক্ত না হলে বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি থাকে না এবং মূল্যবৃদ্ধি নয়, কমে। জ্বালানি তেলকে যদি চুরি এবং অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়মুক্ত করতে হয়, তাহলে দরকার বিইআরসি আইনমতে মূল্য নির্ধারণ করা এবং সেই সঙ্গে লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ড তথা প্রশাসনকে আমলামুক্ত করা।
ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিইআরসি আইন লংঘন করে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য অবৈধ উপায়ে জ্বালানি বিভাগ এবং ফার্নেসওয়েলের মূল্য বিপিসি নিজে নির্ধারণ করে। ফলে পেট্রেলিয়ামজাত জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ বিইআরসি’র কর্তৃক বৈধভাবে নির্ধারণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জ্বালানি বিভাগ কর্তৃক সালের ০৩ নভেম্বর গেজেটে প্রকাশিত ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন চ্যালেঞ্জ করে ক্যাব রিট আবেদন করে এবং ২৯ নভেম্বর রুল ইস্যু হয়। উচ্চ আদালতে উক্ত মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় বিপিসি নিজেই বিইআরসি আইন লংঘন করে ফার্নেসওয়েলের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রাখে। বিষয়টি অপর একটি সম্পূরক আবেদনের মাধ্যমে অবহিত হয়ে উচ্চ আদালত মূল মামলাটি চূড়ান্ত শুনানির জন্য তালিকায় আনতে চলতি বছরের ২২ মে আদেশ দেন। অন্যদিকে বিইআরসির আইন লংঘনের দায়ে বিপিসি’র বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্যাব ২৯ মে বিইআরসি’র নিকট আবেদন করেছে। যদিও বিইআরসি নিষ্ক্রীয়। ওই রিট মামলায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বিইআরসি ও বিপিসি রেসপনডেন্টস।’
তিনি বলেন, ‘আলোচ্য বিবরণীতে দেখা যায়, রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের তিন কর্তৃপক্ষীয়/নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বিইআরসি ও বিপিসি আইন উপেক্ষা ও লংঘন এবং বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে বেপরোয়া। ফলে জ্বালানি খাতে আইনের শাসন অচল। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তা অধিকার ভয়ানক ভাবে বিপর্যস্ত। এমন দৃষ্টান্ত কোন সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। তাই আমরা এমন পরিস্থিতির অতি দ্রুত পরিবর্তন চাই।’
এই পরিবর্তনের জন্য ক্যাবের পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি জানিয়েছেন ড. এম শামসুল আলম। সেগুলো হলো-
– জ্বালানি বিভাগ/বিপিসি’র পরিবর্তে ডিজেল, ফার্নেসওয়েল এবং কেরোসিনের মূল্য পবিবর্তন/সমন্বয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের শুনানির ভিত্তিতে বৈধ ভাবে বিইআরসি কর্তৃক নিশ্চিত করা।
– কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল দ্বারা বিপিসি’র আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তরল জ্বালানি ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়াদি নিবিড় পর্যালোচনা করানো।
– জ্বালানি খাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সকল লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ড তথা প্রশাসন থেকে জ্বালানি বিভাগসহ সকল মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকর্তাদের অবমুক্ত করা। এসব কর্মকর্তা কর্তৃক লাইসেন্সিদের নিকট থেকে গৃহীত আর্থিক সুবিধাদি অবৈধ বিধায় গৃহীত সমূদয় অর্থ তাদের নিকট থেকে আদায় করা।
– বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য নির্ধারণের অপরাধে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট সচিব/সিনিয়র সচিব (ভূতপূর্বসহ) এবং বিপিসি’র চেয়ারম্যানকে (ভূতপূর্বসহ) বিইআরসি আইনের ৪২ ধারামতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আওতায় আনা।