ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ডলার সংকটের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবারও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের শুরু থেকে এলএনজি আমদানি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা। সমস্যা হলো, চাইলেও সরকার বেশি পরিমাণে এলএনজি আমদানি করতে পারছে না। কারণ, মজুত করার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের হিসাবে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ চার লাখ ৯০ হাজার টন এলএনজি আমদানি করেছে। ২০২২ সালের জুনের পর গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি এলএনজি কিনেছে বাংলাদেশ।
পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এলএনজির দাম বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব বাজারে যখন পণ্যটির দাম বাড়ে বাংলাদেশকে তখন বাড়তি অর্থ দিয়ে স্পট মার্কেট থেকে কিনতে হয়। কিন্তু যখন দাম কমে তখন অধিক পরিমাণে এলএনজি আমদানি করে মজুত করার সুযোগ তৈরি হলেও সেটি নিতে পারে না বাংলাদেশ। কারণ, আমাদের অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে। বিদ্যমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে দৈনিক সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা যায়। টার্মিনালের সংখ্যা বাড়ানো গেলে কম দামে এলএনজি কিনে মজুত করা যেত। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো।
সর্বশেষ গত ০৩ মে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে চার কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়। ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ ধারণক্ষমতার মোট চার কার্গো এলএনজি কিনতে ব্যয় হবে দুই হাজার ১৪ কোটি টাকা।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান গ্যাসের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয় এলএনজির এ আমদানি। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট (পেট্রোবাংলার সর্বশেষ তথ্য, ৪ মে)। বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় এবং ডলার সংকট পুরোপুরিভাবে না কাটায় গ্যাসের এ সরবরাহ এখনই বাড়ানো সম্ভব নয়।
বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম কমে যাওয়ায় আমদানির সক্ষমতা বাড়লেও বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যমান অবকাঠামো। বর্তমানে দেশে এলএনজি সরবরাহের জন্য ভাসমান টার্মিনাল রয়েছে দুটি। টার্মিনাল দুটির সক্ষমতা ১০০ কোটি ঘনফুট হলেও সরবরাহের দৈনিক পরিমাণ সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট। কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত টার্মিনাল দুটির মালিকানা যথাক্রমে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ও দেশীয় কোম্পানি সামিট গ্রুপ।
মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করে এক্সিলারেট এনার্জি। নির্মাণ শেষে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। ১৫ বছর মেয়াদি এ টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি রয়েছে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। তবে, কোম্পানিটি এরই মধ্যে চুক্তির মেয়াদ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
অপরদিকে, সামিট গ্রুপ ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি সই করে। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। এ টার্মিনালের মেয়াদ রয়েছে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে আরও একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ হলে সাশ্রয়ীমূল্যে আমদানি করা গ্যাসের মজুত ও সরবরাহ বাড়ানো যেত। গত কয়েক বছরে টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার অস্তিত্ব কেবল কাগজে-কলমে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে মাতারবাড়ী ও পায়রায় আরও দুটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পেট্রোবাংলাকে পৃথক প্রস্তাব দিয়েছে সামিট গ্রুপ ও এক্সিলারেট এনার্জি। প্রস্তাবনা নিয়ে বেশ কয়েক দফা বৈঠক হলেও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র এখনও আবিষ্কার না হওয়ায় এলএনজি আমদানি বহাল রাখতেই হবে। সেজন্য এলএনজি আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে পায়রায় নতুন টার্মিনাল নির্মাণের জন্য চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি, শিগগিরই তা সম্পন্ন হবে। পায়রার এ টার্মিনালের সক্ষমতা হবে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ঘনফুট। সামিট গ্রুপও একটি ভাসমান টার্মিনালের প্রস্তাব দিয়েছে। সেটা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া মহেশখালীতে স্থলভাগে একটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ টার্মিনালের সক্ষমতা হবে ১০০ কোটি ঘনফুট। এ জন্য জমিও নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো সমস্যা না হলে নির্বাচনের আগেই টার্মিনালের কাজ শুরু করা যাবে।