ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ তাপদহের কবলে পড়েছে দেশ। বেশ কয়েক দিন ধরে চলা ভয়াবহ এ তাপপ্রবাহে অস্থির হয়ে উঠেছে জনজীবন। তীব্র গরমে হাসফাস করছে খেটে খাওয়া মানুষজন। আর এ সময়েই সারা দেশে চলছে তীব্র লোডেশেডিং। রমজান মাসে এমন লোডশেডিং ক্ষুব্ধ করেছে ভোক্তাদের।
এদিকে দেশে টানা তিন দিন রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের কীর্তি গড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গত বৃহস্পতিবার রেকর্ড ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)। এর আগের দিন বুধবার উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ১৪ হাজার ৯৩২ মেগাওয়াট এবং তার আগের দিন মঙ্গলবার ছিল রের্কড ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। যদিও বর্তমানে একই হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। তবে সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময়েও লোডশেডিং থাকায় রেকর্ড অর্জনটিও ফিকে (উজ্জ্বলতাহীন) হয়ে পড়েছে ভোক্তাদের কাছে ।
এর আগে, গত বছরের ১৬ এপ্রিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এরপর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ কমতে থাকে দেশে। আর এর জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করে সরকার। এসময়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে সিডিউল করে লোডশেডিং দেওয়া সহ নানান উদ্যোগ নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে শীত মৌসুমে চাহিদা কমায় কমতে থাকে লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতা।
এদিকে দেশে লোডশেডিং থাকায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অত্যাধিক তাপমাত্রায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের ঘাটতি বেড়েছে। যার কারণে উৎপাদন বাড়িয়েও ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছে না। এতে অনেকটা বাধ্য হয়েই লোডশেডিং বাড়াতে হয়েছে। অন্যদিকে লোডশেডিং দূর করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ তাদের ।
শুক্র, শনি ও রোববার (১৪, ১৫, ১৬ এপ্রিল) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর, ডেমরা, মালিবাগ, বাড্ডা, বনশ্রী, মিরপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। লোডশেডিংয়ের কারণে দেখা দিয়েছে পানির সঙ্কটও। বৈরী আবহাওয়া এবং বিদ্যুৎ সংকটে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শিশু-বৃদ্ধসহ অনেকই।
উত্তর যাত্রাবাড়ীর তরকারি ব্যবসায়ী আলম মন্ডল শনিবার রাতে ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, শুধু সন্ধ্যার পরেই ৩ বার গেলো কারেন্ট। দিনেও গেছে ২ থেকে ৩ বার। এখন বিদ্যুৎ না থাকায় দোকান করতে পারছি না। এই গরমের মধ্যে যদি কারেন্ট না থাকে, তাহলে বাঁচাই কষ্ট।
শুক্রবার বিকেলে পল্টনের একটি বেসরকারি অফিসের মো: জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যুৎ নেই। যার কারণে কাজ করতে পারছি না। এই এলাকায় সাধারণত বিদ্যুৎ যায়না। তবে আজ দুইবার গেলো। জানি না সামনে কি হবে।’
তবে গ্রাম অঞ্চল গুলোতে এই লোডশেডিংয়ের তীব্রতা ভয়াবহ। রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, সিলেট, কুড়িগ্রাম, যশোর, রংপুর, পঞ্চগড়, বাগেরহাট, নাটোর, নওগাসহ বিভিন্ন জেলায় চলছে ভয়াবহ এ লোডশেডিং। বিশেষ করে জেলার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতাধীন অঞ্চল গুলোতে চলছে তীব্র লোডশেডিং। এ অঞ্চল গুলোতে ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পাওয়ায় কৃষি সেচ সঙ্কটে ফসলি ক্ষতির শঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা।
নওগাঁর আজাদুল ইসলাম রোববার বিকেলে ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, আগের থেকে লোডশেডিং বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৪ ঘন্টা করে লোডশেডিং চলছে পল্লী বিদ্যুত এলাকায়। এই রৌদ্রে লোডশেডিং বাড়লে কৃষি খাতে বড় ক্ষতি হবে।
বাগেরহাটের অরিন্দম দেবনাথ একই দিন সন্ধ্যার দিকে ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ঘন্টায় ঘন্টায় হচ্ছে লোডশেডিং। আজ একটু কম হলেও, গতকাল ছিলো আরও বেশি। দিনে অন্তত ৫ থেকে ৬ ঘন্টা চলছে লোডশেডিং। গরমের মধ্যে এমন লোডশেডিংয়ে অবস্থা ভালো নয়।
নাটরের পরিতোষ কুমার বলেন, আগের থেকে বর্তমানে লোডশেডিং এর পরিমাণ বেড়েছে। শহরে লোডশেডিং কম হলেও গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। দিনে অন্তত ৩ থেকে ৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে কৃষি ফসলিতে প্রভাব পড়তে পারে।
ফরিদপুরের ইমদাদুল শেখ শনিবার রাতে জানান, দিনে-রাতে বারবার বিদ্যুৎ যাচ্ছে। কোন কোন সময় অন্তত ১ থেকে দেড় ঘন্টা পর বিদ্যুৎ আসতেছে। গরমের মধ্যে এতো লোডশেডিং হওয়ায় পোলাপান নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
রাজবাড়ীর বাবু মোল্লা শনিবার রাত ১১ টার দিকে ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, এখন বিদ্যুৎ নাই। এটা পল্লী বিদ্যুতের লাইন। প্রায় ১ ঘন্টা হয়ে গেলো বিদ্যুৎ গেছে। গরমের মধ্যে বসে আছি। দিনের বেলায় তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ গেছিলো।
এদিকে লোডশেডিং-এর কারণে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে বিউবোসহ বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা কোম্পানিগুলো। বিবৃতিতে বিউবো জানিয়েছে, ‘চলমান গ্রীষ্মমৌসুমে তীব্র দাবদাহ এবং রমজান মাসের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা অত্যধিক পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, রামপাল ৫০০ মেঃওঃ থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আশুগঞ্জ ৯০০ মেঃওঃ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও চট্টগ্রামে ২১০ মেঃওঃ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ত্রুটির কারণে বন্ধ থাকা এবং হাটহাজারি ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের পিটি বিস্ফোরণের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে।’
এর আগে কয়লাভিত্তিক নতুন কয়েকটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসা এবং গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত মাস থেকে চাহিদার কাছাকাছি ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন। এতে লোডশেডিং হলেও তা ছিল ন্যূনতম পর্যায়ে। এমনকি এক সপ্তাহ আগেও তা সীমিত আকারেই ছিল। তবে বৃহস্পতিবার রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও দেশে বড় ধরনের লোডশেডিং হয়। আর শুক্রবার ছুটির দিনে (১৪ এপ্রিল) আগের রেকর্ড ভেঙে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও লোডশেডিং’র মাত্রা ভয়াবহ রূপ নেয়।
বিউবো’র তথ্য বিশ্লেষণে, গত ১০ এপ্রিল দুপুর ৩টায় সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল ২৫১ মেগাওয়াট। ওই সময় ১৩ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ১১ এপ্রিল বেলা ১১টায় সর্বোচ্চ ৩৬৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। ওই সময় ১২ হাজার ৫৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আর ১২ এপ্রিল রাত ১২টায় সর্বোচ্চ ৭৪৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৪৪১ মেগাওয়াট।
এছাড়াও ১৩ ডিসেম্বর রাত ৯টায় দেশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। তবে ওইদিন সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল বিকেল ৪টায় ৭৭৬ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ২৮০ মেগাওয়াট। কিন্তু পরের দিন শুক্রবার ছুটির দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করে লোডশেডিং। ওইদিন রাত ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়। এর মধ্যে রাত ৩টার দিকে সর্বোচ্চ এক হাজার ২৮০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩২৮ মেগাওয়াট।
রোববার দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ১৪ হাজার মেগাওয়াট এবং রাতে চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে দিনে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৫৩ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ১৪ হাজার ৫৯৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে এর আগের দিন শনিবার একই পরিমান বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও এর বিপরীতে উৎপাদন হয়েছিল দিনে ১২ হাজার ৭১৫ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ১৩ হাজার ৯৬৯ মেগাওয়াট। অথাৎ চাহিদার তুলনায় (১৬০০০-১৩৯৬৯) এ দিন ২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিলো। আর এই ঘাটতি মোকাবিলা করতে দেওয়া হয় লোডশেডিং, যদিও রোববার সেটা কমে আসে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো: হাবিবুর রহমান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। যার কারণে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। যাতে লোডশেডিং না করতে হয়, সেই বিষয়ে আমরা কাজ করছি। তবে গরম কমে গেলে লোডশেডিং এমনিতেই কমে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সরবরাহ কমেছে। যার কারণে লোডশেডিংও বেড়েছে। আমরা ওটা চালু করার চেষ্টা করছি। বন্ধ কেন্দ্রগুলো চালু হলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
গত শুক্রবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। কিন্তু শনিবার তা বেড়ে হয় ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রোববার সেটা বেড়ে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠেকেছে। তবে এদিন রাজশাহীতে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৬৫ সালে ঢাকাতে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
তবে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম. শামসুল আলম বলেন, যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, চাহিদা তার থেকে অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাওয়ার প্লান্ট থাকলেও ডলার সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। যার কারণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। ভোক্তাদের কথা ভেবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার পরেও লোডশেডিং চলছে। কিন্তু এখানে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ আছে কি-না, সেটা দেখা দরকার। গ্রামে ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে বলে অভিযোগ পাচ্ছি। এই গরমের মধ্যে এমন লোডশেডিং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তাই গ্রাহকের কথা বিবেচনা করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা নিশ্চিত করা এখন গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে জ্বালানি (তেল-গ্যাস) আমদানি করে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো দরকার।
উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (ক্যাপটিভ সহ) ২৬ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট, বাকিটা অলস পড়ে থাকতে হয় জ্বালানি সংকটে। এর বিপরীতে গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৮০ লাখ। মাথা পিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬০৯ কিলোওয়াট। বিতরণ লস (সিস্টেম লস) চলছে ৭.৭৪ শতাংশ। বিদ্যুতের আওতায় শতভাগ এবং সোলার হোম সিস্টেমে রয়েছে ৬০ লাখ মানুষ।