দুই মাসে খালাসেই ‘উধাও’ আড়াই হাজার টন জ্বালানি তেল

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যখন চরম অস্থিরতা, ডলার সংকটে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে অনীহা দেখাচ্ছে, তখন খালাসেই দুই মাসে উধাও চড়া দামে কেনা সরকারের আড়াই হাজার টন জ্বালানি তেল। অথচ বিষয়টিকে মামুলি ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিচ্ছে দেশের তরল জ্বালানি আমদানি, বিপণন ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এমনকি তাদের দাবির সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না বাস্তব তথ্যেরও।

অনুসন্ধানে গত দুই মাসে (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) জাহাজ থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রধান ডিপোর শোর ট্যাংকে খালাস নিতেই দুই হাজার ৪৫০ টন জ্বালানি কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে খালাস প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত কেউ কথা বলতে রাজি নন। 

তবে বিপিসির দাবি, জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল শোর ট্যাংকে খালাসের সময় লসের (তেল কমে যাওয়া) গ্রহণযোগ্য মাত্রা রয়েছে। এ পর্যন্ত কোন জাহাজেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি লস হয়নি।

জ্বালানি বিতরণ কোম্পানি পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল এবং বিপিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে শোর ট্যাংকে যে পরিমাণ তেল নেওয়া হতো, সে হিসাবে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তেলের মূল্য পরিশোধ করা হতো। দীর্ঘদিন থেকে জাহাজ থেকে শোর ট্যাংকে জ্বালানি খালাস নিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তেল কমে যাওয়ায় সরবরাহকারী, শিপিং এজেন্ট ও বিপিসির মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত হয়, আমদানির জ্বালানি তেল নিয়ে চট্টগ্রাম বহির্নোঙরে আসার পর নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে সার্ভে করে জাহাজেই তেলের পরিমাণ নির্ধারণ করে বিল পরিশোধ করার। এ ক্ষেত্রে জাহাজ থেকে শোর ট্যাংকে খালাস নিতে যে পরিমাণ তেল কমে যায়, তা বিপিসির অপারেশনাল লস হিসেবে দেখানো হয়।

বিপিসির দাবি, জাহাজ থেকে শোর ট্যাংকে জ্বালানি খালাস নেওয়ার সময় শূন্য দশমিক তিন শতাংশ কমে যাওয়াকে গ্রহণযোগ্য মাত্রা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি তেল খালাস প্রক্রিয়ায় অপারেশনাল লসের আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মান শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ। কিন্তু আমাদের দেশে এ গ্রহণযোগ্য মান শূন্য দশমিক তিন শতাংশ। এখন শূন্য দশমিক তিন শতাংশও লস হয় না বলে দাবি এই কর্মকর্তার।

বিপিসির আরেক কর্মকর্তা বলেন, এখন জাহাজ থেকে জ্বালানি খালাসে শূন্য দশমিক দুই শতাংশের কম-বেশি ওঠানামা করে। তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। ‘এমটি হাফনিয়া হ্যানরিত্তি’জাহাজটি ইন্দোনেশিয়ার বাটু আমপার বন্দর থেকে আমদানির ডিজেল নিয়ে গত ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে। নিয়ম অনুযায়ী বিপিসি এবং জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সার্ভে হয়। সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী জাহাজটি থেকে ৩৩ হাজার ৮০০ টন তেল বুঝে নেয় বিপিসি। কিন্তু জাহাজ থেকে পদ্মা অয়েলের শোর ট্যাংক পর্যন্ত যেতেই তেলের পরিমাণ কমে হয় ৩৩ হাজার ৫৬৩ টন। এখানেও উধাও প্রায় ২৩৬ টন ৬০০ লিটার পরিশোধিত ডিজেল।

খালাস শেষে গত ১৩ অক্টোবর অপারেশনে নিয়োজিত পদ্মা অয়েল কোম্পানির লোডিং মাস্টার জাহাজটির মাস্টার ও প্রধান কর্মকর্তাকে দেওয়া এক প্রতিবাদলিপিতে (লেটার অব প্রটেস্ট) ২৩৬ টন ৬০০ লিটার বা ১ হাজার ৭৬৮ ব্যারেল ডিজেল কম পাওয়া কথা উল্লেখ করেন। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী প্রতি ব্যারেল ১৩০ ডলার হিসেবে ওই জাহাজেই বিপিসির লোকসান কমপক্ষে দুই লাখ ২৯ হাজার ইউএস ডলার।

একইভাবে ‘এমটি এমফিট্রিয়ন’নামের জাহাজটি মালয়েশিয়ার প্যাংগিরাং বন্দর থেকে ১০ হাজার ৬৯৭ মেট্রিক টন ডিজেল এবং ২০ হাজার ৭৫৭ টন জেট এ-১ ফুয়েল নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে। বহির্নোঙরে আসার পর সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী জাহাজটি থেকে ১০ হাজার ৬৯৭ টন ডিজেল এবং ২০ হাজার ৭৫৭ টন জেট এ-১ ফুয়েল বুঝে নেয় বিপিসি। কিন্তু জাহাজ থেকে প্রধান ডিপোর শোর ট্যাংকে গেলে ডিজেলের পরিমাণ হয়ে যায় ১০ হাজার ৬৬৪ টন এবং জেট এ-১ ফুয়েল কমে হয় ২০ হাজার ৬৭২ টন।

হিসাব অনুযায়ী, ওই জাহাজ থেকে শোর ট্যাংকে যেতে উধাও হয় ৩৫ টন বা ২৬৪ ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেল এবং ৮৫ টন বা ৬৭৪ ব্যারেল জেট এ-১ জ্বালানি।

খালাস শেষে গত ১১ নভেম্বর অপারেশনে নিয়োজিত পদ্মা অয়েল কোম্পানির লোডিং মাস্টার জাহাজটির মাস্টার এবং প্রধান কর্মকর্তাকে দেওয়া এক প্রতিবাদলিপিতে (লেটার অব প্রটেস্ট) ৩৫ টন ৩০৭ লিটার বা ২৬৪ ব্যারেল ডিজেল এবং ৮৫ টন বা ৬৭৪ ব্যারেল জেট এ-১ ফুয়েল কম পাওয়া কথা উল্লেখ করেন।

সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী, প্রতি ব্যারেল ডিজেল ১৩০ ডলার এবং প্রতি ব্যারেল জেট এ-১ এর মূল্য ১২৪ ডলার হিসেবে ওই জাহাজেই বিপিসির লোকসান কমপক্ষে এক লাখ ১৭ হাজার ইউএস ডলার।

একইভাবে ‘এমটি বো ট্রিডিয়েন্ট’জাহাজটি আমদানির ডিজেল নিয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসে। সার্ভে প্রতিবেদন পরবর্তী কিছু ডিজেল লাইটারিং করার পর সরাসরি জাহাজ থেকে ডিপোর শোর ট্যাংকে খালাস নেওয়া হয়।

সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, জাহাজ থেকে বিপিসি ২৬ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন জ্বালানি বুঝে নিলেও শোর ট্যাংকে খালাস নিতে গিয়ে ১৩২ টন কমে ডিজেলের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ হাজার ২৪৮ মেট্রিক টনে। এক্ষেত্রেও প্রতিবাদলিপিতে (লেটার অব প্রটেস্ট) ১৩২ টন বা ১০০৩ ব্যারেল ডিজেল কম পাওয়ার কথা জানানো হয়। আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী এখানেও বিপিসির লোকসান অন্তত এক লাখ ৩০ হাজার ইউএস ডলার।

এই তিন জাহাজের অপারেশনাল লস হিসেবে কমে যাওয়া জ্বালানি তেলের পরিমাণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এমটি হাফনিয়া হ্যানরিত্তি জাহাজটি থেকে বিপিসি তেল কেনে ৩৩ হাজার ৮০০ টন বা দুই লাখ ৫২ হাজার ৫২২ ব্যারেল। এতে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় অপারেশনাল লস শূন্য দশমিক তিন শতাংশ হিসেবে শোর ট্যাংকে নিতে তেল কমার কথা ৭৫৮ ব্যারেল। কিন্তু জাহাজটি থেকে খালাসে ১ হাজার ৭৬৮ ব্যারেল ডিজেল কম পাওয়ার কথা চিঠিতে জানানো হয়। এতে ওই জাহাজে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ১০১১ ব্যারেল তেল কমে যায়।

এমটি এমফিট্রিয়ন থেকে ১০ হাজার ৬৯৭ মেট্রিক টন বা ৮০ হাজার ৩৯ ব্যারেল ডিজেল এবং ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৭৩ ব্যারেল জেট এ-১ ফুয়েল থেকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ২৪০ ব্যারেল ডিজেল এবং ৪৯৩ টন জেট এ-১ ফুয়েল অপারেশনাল লস হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে কমেছে ২৬৪ ব্যারেল ডিজেল এবং ৬৭৪ ব্যারেল জেট এ-১ ফুয়েল, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়েও অতিরিক্ত ২৪ ব্যারেল ডিজেল এবং ১৮১ ব্যারেল জেট এ-১ জ্বালানি কমেছে।

একইভাবে এমটি বো ট্রিডিয়েন্ট থেকে নেওয়া ২৬ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন বা ২ লাখ ১ হাজার ১২৭ ব্যারেল থেকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ৬০৩ ব্যারেল অপারেশনাল লস হিসেবে কমে যাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে কমেছে ১০০৩ ব্যারেল, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়েও অতিরিক্ত ৪০০ ব্যারেল জ্বালানি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি তেল বিপণনে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার তেল চুরি হয়। সিস্টেম লসের নামেও চুরি হয়। অথচ অটোমেশন হলে সিস্টেম লস কমে আসবে। তেল চুরিও কমবে।

২০১৭ সালের ০৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে মেঘনা পেট্রোলিয়াম কোম্পানির এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, তেল (তরল জ্বালানি) চুরি বন্ধ হলে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তার এ বক্তব্যের পরও তেল চুরি বন্ধে এখনো কার্যকর কোন পদক্ষেপ নজরে আসেনি।

প্রায় সব জাহাজ থেকে আমদানি করা জ্বালানি তেল শোর ট্যাংকে খালাসে অতিরিক্ত পরিমাণে কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিপিসি পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্লানিং) ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব খালিদ আহম্মেদ বলেন, জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল খালাসে অপারেশনাল লস হয়, এটা সত্য। এই লসের গ্রহণযোগ্য মাত্রাও রয়েছে। বর্তমানে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় অপারেশনাল লস শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ ধরে হিসাব করা হয়। খালাসে গ্রহণযোগ্য মাত্রায়ই অপারেশনাল লস হয়। কোথাও অতিরিক্ত তেল কমে যাওয়ার তথ্য নেই।

এরপর গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়েও অতিরিক্ত জ্বালানি কমে যাওয়ার তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনটি হয়ে থাকলে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।

এ বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান এবং সরকারের সচিব এ বি এম আজাদের দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে খুদেবার্তা দেওয়া হলেও কোন সাড়া মেলেনি। জাগো নিউজ।