ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ভারত থেকে ডিজেল আমদানির জন্য তৈরি করা বাংলাদেশ–ভারত মৈত্রী পাইপলাইন দিয়ে আমদানি করা ডিজেল দিয়ে উত্তরাঞ্চলের ষোল জেলার চাহিদা পূরণ করার আশা করছে কর্তৃপক্ষ এবং এ জন্য খরচও আগের চেয়ে কমবে বলে দাবি করছে তারা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গতকাল (শনিবার) এই পাইপলাইনটির ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেছেন।
যে চুক্তির আওতায় এই পাইপলাইন তৈরি করা হলো এবং ডিজেল আমদানি করা হবে তাতে কি আছে তা বিস্তারিত প্রকাশ না করায় এ পাইপলাইন বাংলাদেশকে জ্বালানীর ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভর করে তোলে কি-না তা নিয়েও উদ্বেগ আছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি অবশ্য বলছে এতদিন যে পদ্ধতিতে ভারত থেকে ডিজেল আনা হচ্ছিলো সেটি আদর্শ ছিলো না বরং এখন নতুন পাইপলাইন হয়ে যাওয়ায় ‘তুলনামূলক কম খরচে’ এবং ‘রিয়েল টাইমে’ জ্বালানি পাওয়া যাবে।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলছেন এখানে শুধু তেল আনাটা সহজ হচ্ছে আর কোনো কিছুই বাংলাদেশ পাচ্ছে না।
“এই পাইপলাইনে আনা জ্বালানি তো কম বা সাশ্রয়ী দামে পাবে না। আবার এখানে কোনা গ্যারান্টেড সাপ্লাইয়ের বিষয়ও নেই। যে পরিমান তেল আসবে তা খুব বড় কিছু নয়,”
বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ অবশ্য বলেছেন নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে কম খরচে উত্তরাঞ্চলের ষোলো জেলায় নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে সক্ষম হবেন তারা।
যদিও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের উপদেষ্টা শামসুল আলম বলছেন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ভারতের আদানি গোষ্ঠীর সাথে যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের হয়েছে তাতে এই পাইপলাইন নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ না করলে বলা কঠিন যে এতে বাংলাদেশের লাভ হবেই।
শামসুল আলম আরও বলেন, “ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠান এই সীমান্ত পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল পাঠাবে। তারাও যদিও আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে যখন তখন দাম বাড়িয়ে বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলে তার থেকে সুরক্ষাকবচ কি ? তা নিয়ে সংসদ বা মন্ত্রিসভা কোথাও কথা হয়েছে?”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ব্যবহৃত জ্বালানির পঁচাত্তর শতাংশই ডিজেল এবং দেশে ডিজেলের চাহিদা প্রায় ৪৬ লাখ টন। এর আশি ভাগই সরকারকে আমদানি করতে হয়।
২০১৭ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রতি মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে দুই হাজার দুশো টন ডিজেল আমদানি হয় বাংলাদেশে।
পাইপলাইন লাভ দিবে বাংলাদেশকে?
বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলছেন এখন রেল ওয়াগনে করে তেল আনতে পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। তার দাবি পাইপলাইনে এলে এ খরচ অনেক কমবে।
“রেল ওয়াগনে অপচয় যেমন হয় তেমনি প্রায়শই নানা দুর্ঘটনায় ক্ষতি হচ্ছে। তাই আমরা মনে করি পাইপলাইনে আনাটাই ‘বেস্ট স্মার্ট’ উপায়,” বলছিলেন বিপিসির চেয়ারম্যান।
অন্যদিকে গত দশই মার্চ দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় ডিজেল রিসিভ টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন যে বর্তমানে প্রতিটি ব্যারেল জ্বালানি পরিবহনে খরচ হয় প্রায় ১১ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার।
কিন্তু পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে জ্বালানি আমদানি শুরু হলে এই খরচ ছয় ডলার পর্যন্ত কমে যাবে বলে জানান তিনি।
কর্তৃপক্ষের দাবি বছরে দশ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত জ্বালানি ভবিষ্যতে এ পাইপলাইনে আনা সম্ভব হবে এবং তাতে করে সার্বিক জ্বালানি পরিবহন খরচ কমবে বলে মনে করেন তারা।
কারণ এখন তেল চট্টগ্রামে এনে সেখান থেকে খুলনা হয়ে পার্বতীপুরে নিতে হয়।
তবে পাইপলাইন আনার ফলে সত্যিকার ভাবে কেমন অর্থ বাংলাদেশের সাশ্রয় হবে সেটি জানতে আসলে আমদানির পর নির্দিষ্ট সময় শেষেই বলা সম্ভব হবে ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলছেন এগুলো নিয়ে কী ধরণের সমীক্ষা হয়েছে এবং চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হয়েছে তা জনগণকে কখনোই জানানো হয়নি।
ভারত সরকারের সাথে সমঝোতা অনুযায়ী পনের বছর মেয়াদে ভারত থেকে প্রতি বছর ডিজেল আমদানির পরিমাণ ক্রমশ বাড়বে।
অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলছেন সর্বোচ্চ অর্থাৎ দশ লাখ টন ডিজেল আনা সম্ভব হলে হয়তো কিছুটা লাভ বাংলাদেশের হতে পারে কিন্তু গ্রাহক তাতে কম দামে পাবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
“সবচেয়ে বড় কথা এই পাইপলাইন প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে উদ্বোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণই নয় বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা বিবেচনায়,” বলছিলেন তিনি।
জ্বালানির বিষয়ে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে উদ্বেগও আছে বাংলাদেশে।
তবে বিপিসির কর্মকর্তারা একটি ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আনা হলে সেটি ডলারের পরিবর্তে ভারতীয় রুপিতে পেমেন্ট দেয়ার বিষয়ে আলোচনার একটি সুযোগ তৈরি করবে।
তাছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারত রাশিয়া থেকে কম দামে তেল আনছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সেই একই প্রক্রিয়ায় তেল আনতে পারে কি-না তা নিয়েও চিন্তা ভাবনা আছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলছেন যে ভারতীয় যেসব প্রতিষ্ঠান জ্বালানি সরবরাহ করবে তারা যে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলবে না বা ফেললেও সেটি মোকাবেলার মতো আইনি রক্ষাকবচ না থাকলে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো হিতে বিপরীত হওয়ারও আশঙ্কা থাকবে।
তিনি আরও বলেন, জ্বালানি আনার ক্ষেত্রে এতো বড় সংস্কার বা ট্রান্সফরমেশন হচ্ছে অথচ সংসদ, মন্ত্রিসভাসহ কোথাও আলোচনা হলো না। আমরা কিভাবে নিশ্চিত হবো যে এই চুক্তি থেকে বাংলাদেশ সত্যিই লাভবান হবে?
অন্যদিকে যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশে সরকার কয়েক দফা জালানির দাম বাড়িয়েও লোকসান সামাল দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডিজেলের জন্য যে বিকল্প উৎসের দরকার ছিলো পাইপলাইনের মাধ্যমে সেটিই কার্যত তৈরি করা হলো।
ইতোমধ্যেই ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল)কে ডিজেল সরবরাহকারী হিসেবে বিপিসি তালিকাভুক্ত করে নিয়েছে।
পাইপলাইন সম্পর্কিত তথ্য
মূলত ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে ডিজেল আনার পরিমাণ বাড়াতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন নামের এই পাইপলাইনটি নির্মাণ করা হয়েছে।
নুমালিগড় রিফাইনারি ও বিপিসির অধীনস্থ কোম্পানি মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।
এনআরএল এবং পার্বতীপুর ডিপোর মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাঁচ কিলোমিটার ভারতে এবং বাকি ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার বাংলাদেশে পড়েছে।
তবে নুমালিগড় থেকে শিলিগুড়ি রেল টার্মিনাল পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন আগে থেকেই ছিলো। এ কারণে ভারত প্রান্তে নতুন করে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করতে হয়েছে।
পাইপলাইনে আনা জ্বালানি পার্বতীপুরের টার্মিনালেই রাখা হবে এবং পরে সেখান থেকে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হবে। সেজন্য এই টার্মিনালে উনত্রিশ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার ডিপো নির্মাণ করা হয়েছে।
২০২০ সালে এই পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিলো এবং এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৫২০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ভারত সরকার দিয়েছে ৩৩৭ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাইপলাইনের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেষ পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ হওয়ার পর তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে তেল আনার কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সূচনা করলেন।