ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ভারত থেকে গত বছরের জুনে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করেছে পাশ্ববর্তী দেশ নেপাল। এ বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে ভারতীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অটোমেটেড বাজার প্লাটফর্ম ‘ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড’ (আইইএক্স) থেকে। প্লাটফর্মটিতে বিদ্যুৎ কেনাবেচা হয় উৎপাদন কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। এতে বিতরণ কোম্পানিগুলোও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ পায়। সম্প্রতি আইইএক্সে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য সুবিধা যুক্ত হয়েছে। প্লাটফর্মটিতে যুক্ত হওয়ার সুবাদে এখন প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে নেপাল। এখান থেকে ১৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে নেপাল। আবার এ প্লাটফর্মকেই কাজে লাগিয়ে দেশটি থেকেই ভারতে বিদ্যুৎ রফতানি হচ্ছে প্রায় ৩৮ মেগাওয়াট।
আইইএক্স থেকে সুলভমূল্যের বিদ্যুৎ কিনতে স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি চার্জের মতো কোনো জটিলতা নেই। একইসঙ্গে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য বাড়ানো গেলে উৎপাদনে নিয়ে আসা যাবে দেশের অব্যবহৃত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও। সেই বিদ্যুৎ বিক্রি করে ক্যাপাসিটি চার্জও তুলে আনতে পারবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। এতে করে সরকারি সংস্থাটির লোকসান কমার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বাণিজ্যেরও বড় পথ তৈরি হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের বিদ্যুৎ খাতে এখন নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোয় মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যুতের কেনাবেচা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আইইএক্স ট্রেডিং প্লাটফর্মে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশেরও। এক্ষেত্রে সেখান থেকে বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়বে আদানির গোড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কেনা দামের অর্ধেকেরও অনেক কম।
আইইএক্স ইনডেক্সের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, আজকের (৭ মার্চ) বাজারে প্লাটফর্মটিতে বিদ্যুতের সম্ভাব্য গড় মূল্য দাঁড়াতে পারে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) ৫ রুপি ৭৭ পয়সা (বর্তমান বিনিময় হারে ৭ টাকা ৪০ পয়সা)। গত বছরের মে ও ডিসেম্বরেও সেখানে বিদ্যুতের গড় মূল্য ওঠানামা করেছে প্রতি ইউনিট ৭ রুপির নিচে। ট্রেডিং প্লাটফর্মটিতে গত বছরের মে মাসে বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ইউনিটপ্রতি ৬ রুপি ৭৬ পয়সা। ডিসেম্বরে তা কমে হয় প্রতি ইউনিট ৫ রুপি ২৩ পয়সা।
অন্যদিকে ক্রয় চুক্তিতে (পিপিএ) জ্বালানির বর্তমানে ধার্যকৃত খরচ বিবেচনায় আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির ব্যয় করতে হবে প্রতি ইউনিট ১৬-১৮ টাকার মতো, যা আইইএক্সে বিদ্যুতের বর্তমান বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি।
আইইএক্সে সাশ্রয়ী মূল্যে এবং দৈনিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই দেশটির বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো এখান থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পেরেছে। এমনকি বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতার মধ্যেও উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে তুলনামূলক সুলভ দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের বাজার থেকে বিদ্যুতের এ প্রতিযোগিতামূলক দামের সুবিধা নিতে পারে বাংলাদেশ। দৈনিক ভিত্তিতে লেনদেন হওয়ায় এখান থেকে প্রতিদিনের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে সাশ্রয়ী মূল্যেরও সুবিধা নেয়া সম্ভব। তবে এজন্য সবার আগে প্রয়োজনীয় সঞ্চালন অবকাঠামো ও সুবিধা গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাহলে কম দামে কেনার পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ রফতানিও করতে পারবে বাংলাদেশ।
কালেভদ্রে মূল্যের ব্যাপক ওঠানামা দেখা গেলেও আইইএক্সে তা কখনই আদানির গোড্ডা কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের ধার্যকৃত মূল্যের ধারেকাছেও যায়নি। ভারতীয় সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত আইইএক্সে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ মূল্য উঠেছে প্রতি ইউনিট ১২ রুপিতে। আবার তা ইউনিটপ্রতি ১ রুপি ৪৯ পয়সায় নামারও রেকর্ড আছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় বিদ্যুতের প্রতিযোগিতামূলক ভারতীয় বাজারটিতে বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য সে সুযোগ তারা তৈরি করেছে। তবে এক্ষেত্রে এখনো বিদ্যুতের আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি। এজন্য সঞ্চালন লাইন গড়ে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে সাশ্রয়ী দামের বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পেতে পারে। একই সঙ্গে এ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা গেলে বাংলাদেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও এ বাজারে অংশ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে দুই দেশের নেটওয়ার্ক সিস্টেম, ফ্রিকোয়েন্সিসহ টেকনিক্যাল বিষয়গুলো সহজ করতে হবে।
দেশের বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার মেগাওয়াট। আর বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা হচ্ছে সাড়ে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অতিরিক্ত সক্ষমতা বসিয়ে রাখায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে এসব কোম্পানিকে। এ চার্জ বিদ্যুতের দামের সঙ্গে সমন্বয় করলে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো (আইপিপি) থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ে গড় খরচ পড়েছে ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। একই বছরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে খরচ হয়েছে গড়ে ৬ টাকা ১১ পয়সা। একই অর্থবছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় খরচ হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। গত অর্থবছরে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ পরিশোধিত অর্থের অর্ধেকেরও বেশি দিতে হয়েছে আইপিপিগুলোকে। ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও আইইএক্সের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার অংশ হিসেবে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বহরমপুর-পাবনা সঞ্চালন লাইন হয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং কুমিল্লা জেলায় ত্রিপুরার সূর্যমনি থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের আওতায় নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যুতে সহযোগিতায় ২০১৮ সালের আগস্টে বাংলাদেশ-নেপালের একটি সমঝোতা সই হয়। বিদ্যুৎ আমদানিতে যৌথ স্টিয়ারিং কমিটি ও যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। শুরুতেই ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য দুই দেশ জোর প্রচেষ্টা চালালেও ভারতের সম্মতির অপেক্ষায় এখনো বিষয়টির সুরাহা হয়নি।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (বিবিআইএন) উদ্যোগের আওতায় সংশ্লিষ্ট চার দেশ আঞ্চলিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে পারস্পরিক সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিবিআইএন দেশগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার সুযোগ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, দেশগুলোয় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার মৌসুমও ভিন্ন ভিন্ন। সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক থেকে সংশ্লিষ্ট চার দেশেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) ‘ক্রস-বর্ডার ইলেকট্রিসিটি ট্রেড অ্যামং বিবিআইএন কান্ট্রিজ অফারস মিউচুয়াল বেনিফিটস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিবিআইএনভুক্ত দেশগুলো আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের মাধ্যমে একে অন্যকে সুবিধা দিতে পারে। এ চার দেশের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে এপ্রিল, মে ও জুনে। ভুটানে থাকে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে। ভারতে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। আর নেপালে বিদ্যুতের উচ্চ চাহিদা থাকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। ফলে দেশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিদ্যুতের উচ্চ চাহিদা থাকায় বিদ্যুতের আন্তঃবাণিজ্য করার বড় সুযোগ রয়েছে। ভারত ও নেপাল এরই মধ্যে আইইএক্সের মতো আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যিক প্লাটফর্মকে কাজে লাগানো শুরু করেছে। ভুটানও শিগগিরই এতে যোগ দিতে যাচ্ছে। কিন্তু জ্বালানির তীব্র চাহিদা ও উদ্বৃৃত্ত বিদ্যুতের সক্ষমতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তেমন সুযোগ নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে আইইইএফএর জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান পারস্পরিক সহায়তা পেতে পারে। বিশেষত এসব দেশের বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা ভিন্ন। ফলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ আমদানি-রফতানির মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রের খরচ এবং ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে এ সুযোগ অনেক বড়। এ সহযোগিতা জোরদার করা গেলে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশগ্রহণ বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশে রফতানির জন্য ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গড্ডায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে আদানি গ্রুপ। এজন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত ডেডিকেটেড সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। চলতি মাসেই কেন্দ্রটি থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আমদানির কথা রয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কয়লার উচ্চমূল্য ও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা শুরু হয়। কয়লার অতিরিক্ত দাম ও বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে এখন আদানির সঙ্গে সইকৃত পিপিএ পর্যালোচনা অথবা বাতিলের দাবি উঠেছে।