ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমানো এবং বিশ্ব বাজারের বর্ধিত মূল্যের ডিজেল সাশ্রয়ের জন্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং দিলেও বাস্তবে সারাদেশে ডিজেলের বিক্রি অনেক বেড়ে গেছে।
গত ২১ জুলাই থেকে ঘোষণা দিয়ে সারাদেশে লোডশেডিং শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজধানীর এক একটি পেট্রোলপাম্প থেকে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ড্রামে, যেটা যায় অফিস ও বাসা বাড়িতে জেনারেটর চালানোর প্রয়োজনে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলমের মতে, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ধনীরা লোডশেডিংমুক্ত হলেও ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ জনগণ।
বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয় ডিজেল চালিত ছয়টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সেই সঙ্গে উৎপাদন কমে যায় অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও। এতে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায় বলে দাবি করে বিদ্যুৎ বিভাগ।
আর বিদ্যুতের সেই ঘাটতি পোষাতে এলাকাভিত্তিক সিডিউল করে এক থেকে দুই ঘন্টা লোডশেডিং দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে কোথাও কোথাও এর থেকে বেশিও লোডশেডিং এর কবলে পড়ছেন গ্রাহকরা। এমনকি গ্রামাঞ্চলে দিনে ৬/৭ ঘন্টা লোডশেডিং হওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে।
এই লোডশেডিং এর কারণে বেড়ে গেছে জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ফসলের মাঠে ইঞ্জিন চালিত কৃষি পাম্পের ব্যবহার। এ’কারণে হঠাৎ করেই দেশে বেড়ে গেছে ডিজেলের বিক্রি। অর্থাৎ জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানো এবং ডিজেল সাশ্রয়ের জন্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং দিলেও সেই লোডশেডিং এর ফলেই খরচ হয় টনকে টন ডিজেল।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) তথ্যমতে, ১৭ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৫ দিনে দেশে ডিজেল (এইচএসডি) বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ২০ হাজার ৮১৪ মে. টন, ১৬ হাজার ৩৭১ মে. টন, ১৫ হাজার ৭২১ মে. টন, ১৪ হাজার ৯৭৯ মে. টন এবং ২৫ হাজার ১৬৮ মে. টন। আর লোডশেড শুরুর পর ২৪ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৫দিনে বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ১৯ হাজার ৩০৭ মে. টন, ১৫ হাজার ৩০৮ মে. টন, ১৭ হাজার ৪৩৭ মে. টন, ১৬ হাজার ৩৫৩ মে. টন এবং ২৮ হাজার ৯৪১ মে. টন। অর্থাৎ লোডশেডিং এর আগের চেয়ে পরে ডিজেলের বিক্রি বেশি হয়েছে।
বিপিসির তথ্যমতে, অগাস্টের ৬ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দেশে ডিজেলের মজুদ ছিল যথাক্রমে চার লক্ষ ২৩ হাজার ৮৩৭ মে. টন, চার লক্ষ নয় হাজার ৬০২ মে. টন, চার লক্ষ এক হাজার ২৮ মে. টন এবং তিন লক্ষ ৯৪ হাজার ৩৮৯ মে. টন। সর্বশেষ ১৯ অগাস্ট ডিজেলের মজুদ ছিল চার লক্ষ ৮৭ হাজার ৪২২ মে. টন এবং ২০ অগাস্ট ছিল চার লক্ষ ৭২ হাজার ৪১৫ মে. টন। অর্থাৎ ১৯ তারিখে ডিজেল বিক্রি হয়েছে ১৫ হাজার সাত মে. টন।
বিপিসি বলছে, একই ভাবে (১৭-২১ জুলাই) অকটেন (এইচওবিসি) বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে দুই হাজার ৬৬৩ মে. টন, এক হাজার ৫১৪ মে. টন, এক হাজার ৫৬০ মে. টন, এক হাজার ৭৪৬ মে. টন, দুই হাজার ৪৯৭ মে. টন। আর লোডশেডিং শুরুর পর অকটেনের ব্যাবহার হ্রাস পেয়ে ২৪ থেকে ২৮ জুলাই বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৮৭৪ মে. টন, এক হাজার ৫৫৯ মে. টন, এক হাজার ৪৮০ মে. টন, এক হাজার ৫৩৫ মে. টন এবং দুই হাজার ৬৬৬ মে. টন।
একইভাবে পেট্রোল (এমএস) বিক্রি কমে গেছে। বিপিসির তথ্যমতে, ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৫দিনের হিসাবে পেট্রোল (এমএস) বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে দুই হাজার ৮৭৩ মে. টন, এক হাজার ৯৪৩ মে. টন, এক হাজার ৬৭০ মে. টন, এক হাজার ৫০৯ মে. টন, দুই হাজার ১৭৪ মে. টন। অথচ পরের ৫দিন (২৪ থেকে ২৮ জুলাই) বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ১৪০ মে. টন, এক হাজার ৬২৭ মে. টন, ১৭৫৮ মে. টন, ১৪০৭ মে. টন এবং ২১৫৫ মে. টন।
এ বিষয়ে রাজধানীর মৎস ভবন মোড়ের রমনা পেট্রোল পাম্পের মালিক ও বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনারস এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে পাম্পে ডিজেল বিক্রি বেড়েছে। আমার এখান থেকে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার লিটার ডিজেল খোলা বোতলে বিক্রি হচ্ছে। এ তেল জেনারেটরে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অফিস বা বাসা-বাড়ির জন্য। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে কমেছে অকটেন বিক্রি। তবে ডিজেল বিক্রি আগের মতই রয়েছে।’
মতিঝিলের পূবালী ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার মো. রফিক ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘আগের থেকে আমাদের পাম্পে ডিজেল বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। তবে সরকারি অফিসের গাড়িতে তেল বিক্রি কমেছে।’
বিক্রি কত লিটার বেড়েছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ধরেন আগে যদি ৫ হাজার লিটার বিক্রি করতাম এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার লিটার।’
একই এলাকার বিনিময় ফিলিং স্টেশনের কর্মচারীরা বলেন, ‘প্রতিদিন এক হাজার থেকে দেড় হাজার লিটার ডিজেল জেনারেটরের জন্য নিচ্ছেন গ্রাহকরা। কেউ কেউ একবারেই ৫০০ লিটার ডিজেল নিচ্ছে বলে জানান তারা।
ক্যাবের জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোয় একদিকে যেমন ডিজেল সাশ্রয় হচ্ছে। অন্যদিকে ডিজেলের মাধ্যমে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে লোডশেডিংমুক্ত থাকছে ধনীরা। কিন্তু লোডশেডিং এর প্রভাবে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষের। আবার লোডশেডিং এর কারণে ইঞ্জিন চালিত পাম্পের ব্যবহারে কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যা কোন মতেই কাম্য নয়। সুতরাং সরকারের এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ জায়গায় কোন সমাধান করতে পারছে না।