ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ইনডেমনিটি একটি অসভ্য আইন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ইনডেমনিটি থাকতে পারে না। অপরাধ করলে বিচার করা যাবে না, এটা কোন সভ্য সমাজে চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (২৯ এপ্রিল ) দুপুরে সিরডাপ মিলনায়তনে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আয়োজিত ‘জ্বালানি সংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন’ শীর্ষক নাগরিক সভায় এমন মতামত উঠে এসেছে। এতে ক্যাবের পক্ষ থেকে ১৩ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
এসময়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, এখন বিদ্যুতের উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু ব্যবহার করতে পারছি না। বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। ইনডেমনিটি একটি ঘৃণিত শব্দ আমাদের রাজনীতিতে। অথচ ২০২২ সালে এসে আবার সংশোধিত করে নবায়ন করা হয়েছে। এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, এলএনজি লবি অনেক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। লুণ্ঠনবৃত্তি বিগত সরকারের মতো অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সংসদ যে ভূমিকা পালন করার কথা, দুঃখজনক হলেও সত্য- সংসদ সঠিকভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ও সিনিয়র সহ-সভাপতি ড. শামসুল আলম বলেন, উইন্ড ম্যাপিং অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ৩০ হাজার মেগাওয়াট। ভারতে এখন বায়ু ও সৌর বিদ্যুতের মূল্যহার কমবেশি ৩ রুপি। ভারত তার পরিকল্পনায় বলছে ২০৩০ সাল নাগাদ সৌর বিদ্যুতের মূল্যহার ১.৯ থেকে ২.৬ রুপিতে নেমে আসবে। আর বায়ু বিদ্যুৎ ২.৩থেকে ২.৬ রুপিতে পাওয়া যাবে। সেখানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌর বিদ্যুৎ ৯.৯৯ টাকা আর বায়ু বিদ্যুতের চুক্তি করেছে ১৩ ২০ টাকায়। কারিগরি সক্ষমতার উন্নয়ন ও বিনিয়োগ ব্যায়ের ন্যায্যতা নিশ্চিত হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম ভারতের মতো হতো।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের কমবেশি ৭ শতাংশ হারে সরবরাহ বৃদ্ধি হলেও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে ১২ শতাংশ। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে করে ভোক্তারা অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধির কবলে পড়ছে। গ্যাস বন্টনে সরকারি খাত বৈষম্যের শিকার। দেশীয় কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কেনা হচ্ছে ১.০৩ টাকায়, আর সমপরিমাণ এলএনজি আমদানিতে ব্যায় করা হচ্ছে ৮৩ টাকা। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নেই বললেই চলে। অথচ তহবিলের ৬৫ শতাংশ অর্থ অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, সম্প্রতি যে সব গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে সবগুলো করেছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। সেই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নতোলা অবান্তর। ইউএসজিএস তাদের এক সার্ভে রিপোর্টে বলেছে বাংলাদেশে আরও ৩২ টিসিএফ গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বর্তমানে বছরে ১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে সে হিসেবে আরও ৩২ বছরের মজুদ রয়েছে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম সঠিক গতিতে না হওয়ায় আজকের এই সংকট। অচলাবস্থার কারনেই আজকে চড়াদামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশীয় গ্যাস তুললে যে লাভ তার চেয়ে না তুললে বেশি লাভ। আমদানি করলে কমিশনের বিষয় থাকতে পারে। এটা শুধু আজকে থেকে নয়, ঐতিহাসিকভাবেই অনুসন্ধানে স্থবিরতা বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তন হলে একটা আশা করা হয়, কিন্তু সেভাবে পরিবর্তন হয় নি। বরং পুর্বের ধারার সঙ্গে নতুন ধারা আমদানি যুক্ত করা হয়েছে। এই অবস্থা থাকলে ৩০ সালে গ্রোগ্যাস খাত পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, সরকার ২ বছরে ৪৬ টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে, ভালো উদ্যোগ। আশাকরি আগের ১০৫টি কূপ খনন প্রকল্পের মতো হারিয়ে না যায়। বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমানার ওপারে মায়ানমার অনেক গ্যাস উত্তোলন করছে। অথচ আমরা গত ১০ বছরে কিছুই করতে পারিনি। এখন সাগরে বিডিং রাউন্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে, স্থলভাগেও কাজ শুরু হয়েছে। তবে এটা খুব বেশি বিলম্বিত হয়েছে। এটা ১০ বছর আগে করা গেলে আজকের এই সংকটের সৃষ্টি হতো না।
অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, জ্বালানি প্রাকৃতিক সম্পদ আর যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ। সংবিধান বলেছে তিন ধরনের মালিকানা অনুমোদনযোগ্য। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান হতে হবে দেশীয় উদ্যোগ, বিদেশি থাকতে পারে সম্পুরক হিসেবে। সমুদ্রে খনিজ সম্পদ আহরনে জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুন্ন রেখে চুক্তি হতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রতি বছর বিদ্যুতের ব্যবহার ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে, আর উৎপাদন বেড়েছে ১২ শতাংশ হারে। এতে করে অনেক বিদ্যুৎ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। যার ফলে বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সরকার সম্প্রতি বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করেছে। বিইআরসি যখন দাম নির্ধারণ করে সেখানে কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা থাকে, জবাবদিহিতা থাকে। তাই তারা বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইনডেমনিটি একটি অসভ্য আইন, এখানে ইনডেমনিটি থাকতে পারে না। অপরাধ করলে বিচার করা যাবে না , এটা কোন সভ্য সমাজে চলতে পারে না। আমরা দীর্ঘ মেয়াদে কয়লার বিপক্ষে, তবে অল্প সময়ের জন্য কয়লার পক্ষে আমরা।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাষ্ট্রের আইন বলছে ইআইএ ছাড়া কোন কিছু করা যাবে না। অথচ প্রতিনিয়ত করে যাওয়া হচ্ছে। আর আমরা শুধু আন্দোলন করেই যাবো! পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করে আপনি ভবিষ্যতে টাকা খেয়ে বাঁচতে পারবেন না।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, কাফকোকে দেশীয় দামে গ্যাস দিতে হতো, আর তার কাছ থেকে সার কিনতে হতো সিঙ্গাপুরের দরে। সরকার বঙ্গবন্ধুর নীতিকথার কথা বলেন, কিন্ত কাজ করছেন তার নীতির বাইরে। কারন তারা রাতারাতি ধনী হতে চাচ্ছে। আমরা লুটপাটকে আর বেশি প্রসারিত করেছি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া এখান থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাংসদ ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আমি জ্বালানির বিষয়টি বেশি বুঝিনা, তবে এখানে যে দুর্নীতি চলছে সেটি বুঝতে হলে বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। অনেক আমলা নিজেদের আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ করছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয় কমিশনগুলো ব্যবহার করছে। কমিশনগুলোকে সঠিকভাবে কাজ করতে দিতে হবে। বিদ্যুতের ইনডেমনিটি টেন্ডার মেন্ডার কিছু লাগবে না, সরকার যা খুশি করতে পারবে। ক্যাপাসিটি চার্জ কয়েকগুন বেড়ে গেলেও কারো কিছু করার থাকবে না। জ্বালানি খাত স্বচ্ছ হতে হবে, এই খাত ১৬ কোটি মানুষকে আক্রান্ত হয়। কপ’য়ে পনের দিনের মধ্যে অর্ধেক সময় ফাঁকা থাকে, কোন ইভেন্ট থাকে না। অথচ অনেক টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়ন নেওয়া হয়।
ক্যাবের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি নীতিমালা করার জন্য জাইকাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্বে আর কোন দেশ এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে বিদেশিদের দায়িত্ব দিয়েছে বলে নজীর নেই। এতে তথ্যপাচার হবে না তার গ্যারান্টি কি।
তিনি বলেন, বিইআরসিকে বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। ক্যাবের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি থাকল। বিইআরসির কোন সীমাবদ্ধ থাকলে সেগুলো দূর করতে হবে। আমরা চাই বিইআরসি জনগণের কথা বলুক। জনগণের টাকায় তহবিল গঠন করা হয়েছে, সেই তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে সুদ আদায় করছে। সেই সুদও জনগণের কাঁধে পড়ছে। এ রকম অনেক অসঙ্গতি রয়েছে।
বাসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আমরা একটি দুষ্টুচক্রে আটকে গেছি। একজন দুর্নীতি করবে আর দাম বাড়বে, আমরা এমন একটি প্রক্রিয়ায় আটকে গেছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারতের চেয়ে এতো বেশি কেনো! আমরা বেশি দামে উৎপাদন করে ভাব নিতে চাই। কিন্তু সেই ভাবের ভারে জনগণ এখন চিড়ে চ্যাপ্টা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দায় চাপিয়ে জনগণের কিভাবে পকেট কাটা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাত তার জলন্ত উদাহরণ ।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা পদ্মা সেতু করলাম, অনেক কিছুই করলাম। বিশেষজ্ঞ এনে কেনো গ্যাস তুলতে পারছি না। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানির পিআরও হিসেবে কাজ করে। তাদের আর কোন ভূমিকা চোখে পড়ে না। এ কথা স্বীকার করে নিচ্ছি রাজনীতিবীদ হিসেবে আমাদের কন্ঠস্বর সেভাবে জোরালো করা যায় নি।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান সভাপতিত্ব করেন। ক্যাবের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক মিজানুর রহমান রাজুর সঞ্চালনায় সমাপনী বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া। সভায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।