এস এম রাজিব: বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত এলপি গ্যাসের খুচরা মূল্য ৯৯৯ টাকায় মিলছে না বাজারে। ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে।
তবে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কেনার কারণে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলপিজি ব্যবসায়ী নেতারা।
শনিবার ও রোববার (২২ ও ২৩ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মগবাজার, পল্টন, ফকিরাপুল, মালিবাগ, মোহাম্মদপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি দামে এলপিজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) বিক্রির চিত্র দেখা গেছে।
কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী (রিটেইলার) ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ থেকে জানানো হয়, পেট্রোম্যাক্স ও লাফস কোম্পানির ১২ কেজির এলপি গ্যাস এক হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। তবে বাসায় পৌঁছানোর ভাড়া আলাদা।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই দোকানী বলেন, এর আগে ১২ কেজির এলপিজি এক হাজার ২০ টাকা করে কেনা পড়তো। এরপর এক হাজার ৫০ টাকা নেওয়া হলো। বর্তমানে এক হাজার ১০০ টাকা করে নিচ্ছে ডিলার পয়েন্টে। তবে শুনতেছি নতুন বোতলে আরও ২০ টাকা বাড়াবে।
ভোক্তা পরিচয়ে যোগাযোগ করা হলে পল্টন টাওয়ার এলাকার রিটেইলার রাফি এন্টারপ্রাইজ থেকে জানানো হয়, ফ্রেশ কোম্পানির ১২ কেজির এলপি গ্যাস বাসায় পৌঁছানোর ভাড়াসহ এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
দাম বেশি নেওয়ার কারণ হিসেবে জানানো হয়, কোম্পানি থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।
মগবাজার রেল গেইট এলাকার রিটেইলার আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজে ১২ কেজির ওমেরা এলপিজির দাম চাওয়া হয় এক হাজার ২০০ টাকা। তবে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর এক হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করছেন বলে জানান এর ম্যানেজার পলাশ।
সে সময় এক হাজার ২০০ টাকা চাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘কর্মচারি সঠিক দাম জানে না।
তারপরও নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নেওয়ার কারণ হিসেবে ডিলার পয়েন্ট থেকে বেশি দাম নেওয়ার কথা জানান পলাশ।
ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে ভোক্তা পরিচয়ে ওই এলাকার ওমেরা কোম্পানির গ্যাসের ডিলার আহমেদ এন্টারপ্রাইজে যান এই প্রতিবেদক। দোকানটির ম্যানেজার আব্দুল লতিফ বলেন, ‘দোকান থেকে নিয়ে গেলে ১২ কেজির এলপিজি এক হাজার ১৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।’
তবে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর বলেন, ‘৯৯৯ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।’ কিন্তু এক হাজার ১৫০ টাকা চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেন, ‘পৌঁছানোর ভাড়াসহ চেয়েছি।’
তবে কোম্পানি থেকে কেনা পড়ছে কতো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোম্পানি আমাদের ৯৯৯ টাকা ধরছে।’
কিন্তু ৯৯৯ টাকায় কিনে ৯৯৯ টাকায় বিক্রি করলে আপনাদের লাভ কি- এমন প্রশ্নে আব্দুল লতিফ বলেন, ‘টার্গেট পূরণ করতে পারলে ৪৫ দিন পর কমিশন পাই, সেটাই আয়।’
কিন্তু কোম্পানি থেকে ডিলার পয়েন্টে ১২ কেজির এলপিজি ৯২৭ টাকা ধরার কথা, বেশি ধরছে কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তা জানি না, আমাদের ৯৯৯ টাকাই ধরছে।’
এদিকে, ফ্রেস, পেট্রোম্যাক্সসহ একাধিক কোম্পানির গ্যাসের ডিলার মগবাজার মোড় এলাকার মেসার্স এস এইচ এন্টারপ্রাইজে জানতে চাইলে ১২ কেজির এলপিজির দাম চায় এক হাজার ২০০ টাকা। তবে দোকান থেকে নিয়ে গেলে এক হাজার ১৫০ টাকা রাখতে চান তারা।
কিন্তু বেশি দাম নেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে জানতে চাইলে ব্যস্ততার অজুহাত দেখান এবং পরে যেতে বলেন আইনজীবী পরিচয় দেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক।
কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে এলপিজি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বসুন্ধরা গ্যাসের ডিলার নাজির আহমেদ মোল্লাহ ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘কোম্পানি থেকে আমাদের বেশি দামে কেনা পড়ে। কিন্তু আপনারা কোম্পানিকে বেশি নেওয়ার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না। তাদেরকে প্রশ্ন করুন- কেন বেশি দাম নিচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার ভোক্তা পর্যায়ে ৯৯৯ টাকা রেট করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে এক হাজার ১০ টাকা থেকে এক হাজার ২৫ টাকায়। অথচ আমাদের দোকান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে দাম নেওয়ার কথা ৯২৪ টাকা। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো তদারকি দেখছি না। দুঃখজনক হলেও সত্য ভোক্তা অধিদপ্তর শুধু দোকানদারকে জরিমানা করতে পারে। কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে পারে না।’
এ বিষয়ে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান নূরুল আমিন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ভোক্তা যেন সঠিক দামে এলপিজি কিনতে পারে- সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে বেশি দাম নেওয়ায় বরিশাল, মানিকগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় জরিমানা করা হয়েছে এবং সেই কোম্পানিকে শোকজ করা হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
বিইআরসি ঘোষিত জুলাই মাসের এলপিজির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৯৯৯ টাকার মধ্যে ডিলারের কমিশন ৩৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার ৩৮ টাকা রয়েছে। সে হিসেবে খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম সর্বোচ্চ ৯৬১ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু ডিলাররা বিইআরসির আদেশকে মানতেই চাইছেন না। তাদের দাবি- আমরাও বিইআরসি নির্ধারিত দরে কিনতে পারছি না। আমাদের কাছ থেকেও বেশি দাম নিচ্ছে আমদানিকারক কোম্পানি।
বিইআরসির বিগত একাধিক দর ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে এলপিজি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. সেলিম খান বরাবরই এর প্রতিকার চেয়ে আসছেন। গত ০২ এপ্রিল বিইআরসি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দর ২৪৪ টাকা কমিয়ে এক হাজার ১৭৮ টাকা নির্ধারণ করে। সেলিম খান ওই সম্মেলনেই প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আপনারা নতুন দর ঘোষণা করলেন। কিন্তু আমদানিকারকরা আজকে মিল গেটে ১২ কেজির দর ঘোষণা করেছে এক হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু বিইআরসির হিসেব অনুযায়ী আমাদের (ডিস্ট্রিবিউটর) পাওয়ার কথা এক হাজার ১০৬ টাকায়। তাই আমাদের পক্ষে বিইআরসি নির্ধারিত দর এক হাজার ১৭৮ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব নয়।
জবাবে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান নুরুল আমিন সেদিন বলেছিলেন, আমরা বিষয়টি দেখবো। মালিকদের সঙ্গে বসে নির্ধারিত দরে বিক্রির বিষয়ে নিশ্চিত করা হবে। যদি কোনো মালিক কথা না শুনতে চায় তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু তারপরও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। কোম্পানির ইচ্ছেমতোই চলছে এলপিজির বাজার।
-এসএম