ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাড়ন্ত দ্রব্যমূল্যের বাজারে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে চেপেছে তিতাসের প্রিপেইড মিটার ভাড়া। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গোপনে গ্যাসের মিটার ভাড়া একলাফে করা হয়েছে দ্বিগুণ। মিটার ভাড়া কেন এত দিতে হবে এবং এত বাড়ানো হবে তা নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ গ্রাহক। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মিটার ভাড়া বাড়ানোর এমন সিদ্ধান্ত জনজীবনে আরও বিপর্যয় ডেকে আনবে। বাড়তি এ খরচ সমন্বয় করতে হিমশিম খাবে নিম্নআয়ের মানুষ।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানান, জানুয়ারিতে হঠাৎ করেই তাদের কাছ থেকে ১০০ টাকার জায়গায় ২০০ টাকা মিটার ভাড়া আদায় করছে তিতাস। দোকানে কার্ড রিচার্জ করতে গেলে সেখানে জানুয়ারি মাসে ২০০ টাকা মিটার চার্জ কাটার বিষয়টি খেয়াল করেন তারা। দোকানিকে প্রশ্ন করলে তাদের অভিযোগের কোনো জবাব তিতাস দেয় না বলে জানান। বিষয়টি নিয়ে আগে থেকে দেওয়া হয়নি কোনো আভাস কিংবা নোটিশ।
সাখাওয়াত হোসেন নামে এক গ্রাহক বলেন, ‘গ্যাস বিল দিতে গিয়ে দেখি মিটার ভাড়া বাবদ ২০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। আগে ছিল ১০০ টাকা। এটা দেখে তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। মিটারের দাম কত যে এত ভাড়া দিতে হবে। ভাড়াই বা আলাদাভাবে আমরা কেন, কতদিন দেবো। আমাদের কিছু না জানিয়েই ভাড়া বাড়ানো হলো। এমনিতেই সব কিছুর দাম বেশি। তার ওপর মিটার ভাড়াও বেশি নেওয়া হচ্ছে। এগুলো দেখার কি কেউ নেই?’
আরেক গ্রাহক তানজিল হুদা বলেন, ‘এমনিতেই বাসায় গ্যাস থাকে না বললেই চলে। এর মধ্যে কার্ড রিচার্জ করতে গিয়ে দেখি টাকা অনুযায়ী ইউনিট কম এসেছে। পরে খেয়াল করে দেখি জানুয়ারি মাসে ২০০ টাকা মিটার চার্জ কাটা হয়েছে। কদিন আগে ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করা হয়েছিল। এখন ১০০ থেকে একেবারে ২০০ টাকা কীভাবে হয়। মিটার ভাড়া এত বেশি এবং কেন বাড়ানো হবে। আমরা আর কত ঘানি টানবো। সবকিছু অসম্ভব হয়ে উঠছে। অথচ সরকার নীরব।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিচার্জের দোকানি কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়ে বাড়ানোর অভিযোগ দিতে বলেন। সে অনুযায়ী ফোন দেওয়া হলে বলা হয় জানুয়ারি থেকে এটা বাড়ানো হয়েছে। ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা বলতে পারবেন না।’
গ্রাহকের অভিযোগ শুনে পরে মিটার ভাড়া বেশি নেওয়ার বিষয়ে গ্রাহক সেজে তিতাসের কাস্টমার সার্ভিস নম্বরে ফোন দিলে জানানো হয়, জানুয়ারি থেকে মিটার চার্জ ২০০ টাকা করা হয়েছে। নোটিশ না দিয়ে এভাবে বিল বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে জানানো হয়, এটা কর্তৃপক্ষের বিষয়।
প্রিপেইড মিটার স্থাপনের ফলে গ্যাসের অপচয় রোধ হবে এবং গ্রাহকের খরচ কমে যাবে- এমন বিষয় সামনে এনে জাইকার সহায়তায় প্রিপেইড মিটার বসানো শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় তিতাস। ২০১১ সালে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। পরে ২০১৭ সালে বাসা-বাড়িতে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। সে সময় প্রিপেইড মিটার ভাড়া ছিল ৬০ টাকা। ২০২২ সালের জুলাই মাসে প্রিপেইড মিটারের ভাড়া ৬০ থেকে ৪০ টাকা বাড়িয়ে এক লাফে ১০০ টাকা করেছিল তিতাস। তখনও গোপনে বাড়ানো হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
এছাড়া গত জুন থেকে পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের পাইকারি দাম ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), যা গত জুন থেকেই কার্যকর রয়েছে। আর প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিটের খরচ ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ৪৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১৮ টাকা করা হয়। সে সময় একটি প্রিপেইড মিটার ২৫-২৬ হাজার টাকায় কিনতে হয় বলে তিতাসের এমডি জানিয়েছিলেন। সে হিসেবে নতুন গ্রাহকের মিটার ভাড়া ১১ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে ১২তম বছর থেকে কি মিটার ভাড়া থাকবে না?
বর্তমানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও জাপানের জাইকার অর্থায়নে দুটি প্রকল্পে মিটার স্থাপনের কাজ চলমান। জাইকার অর্থায়নে বসানো হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার এবং এডিবির অর্থায়নে ৮ হাজার ৬০০টি মিটার স্থাপন করা হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে চলমান প্রকল্পের আওতায় আরও ১ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের লক্ষ্যে একটি প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে। জাইকার অর্থায়নে আরও ১১ লাখ মিটার স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।
বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে তিতাসের ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬০০টি প্রিপেইড মিটার রয়েছে। এর আগে প্রতি মাসে ৩ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা মিটার ভাড়া চার্জ হিসেবে আদায় করা হতো। নতুন নিয়মে গ্রাহকদের থেকে আরও সমপরিমাণ অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এতে গ্রাহকের থেকে মিটার ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ৬ কোটি ৫৭ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় হবে তিতাসের।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ‘২০০৩ এর ধারা ২২ (খ) এবং ৩৪ অনুসারে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (তিতাস গ্যাস) ডিস্ট্রিবিউশন চার্জ ও ভোক্তাপর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিষয়ে আগ্রহী পক্ষগণকে গণশুনানি প্রদানপূর্বক বিস্তারিত পর্যালোচনা করে আদেশ দিয়ে থাকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।’ তবে মিটার ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে কিছুই জানে না সংস্থাটি।
বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘তিতাস মিটার ভাড়া বাড়িয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’
তিতাসের এমন সিদ্ধান্ত অযৌক্তি ও ভয়ংকর বলে মনে করছে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘গ্যাসের বিলের মধ্যেই মিটার চার্জ সমন্বয় করে নেওয়ার কথা। কিন্তু তিতাস আলাদা ভাবে মিটার চার্জ নিচ্ছে। এটা নেওয়ার এখতিয়ার তিতাসের নেই। বিল বাড়ানোর কোনো এখতিয়ারও তিতাসের নেই।’
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘এটা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। মন্ত্রণালয় থেকেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলমকে ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোনে মন্তব্য করতে রাজি হননি এবং তিতাসের এমডির সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। জাগো নিউজ।