ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: কয়েক বছর আগের কথা। উদ্বিগ্ন এক দাদার অনুরোধে একমাত্র নাতনিকে দেখতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। আজকের দিনে কলে বাসায় গিয়ে রোগী দেখার চল উঠে গেছে বললেই চলে। তার উপর পেশাগত ব্যস্ততা আর ঢাকার ট্রাফিকের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সারাদিনে একটির বেশি দুটি হাসপাতালে রাউন্ড দেওয়াই দুষ্কর। কাজেই বাসায় কল এটেন্ড করার এখন আর প্রশ্নই আসে না। তারপরও সেদিন গিয়েছিলাম অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে নয়, বরং একজন উদ্বিগ্ন দাদার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এবং পাশাপাশি দেশবরেণ্য ঐ রাজনীতিবিদের অনুরোধের সম্মান রাখতে।
গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার জন্য অবশ্য আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। না, আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেননি তিনি। অবাক হয়েছিলাম তার নাতনির রিপোর্ট দেখে। বয়স বড় জোড় দুই থেকে আড়াই। এর আগে কখনোই কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ইতিহাস তার নেই।
এবারের জ্বর কিছুতেই বশে আসছে না দেখে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে রক্তের কালচার করতে গিয়েই বেধেছে বিপত্তি। রিপোর্ট দেখাচ্ছে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকে তার রেজিস্ট্যান্স আছে, অথচ সে তো এর আগে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই খায়নি।
ঢাকায় অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সুপরিচিত ল্যাবরেটরি থেকে এসেছে রিপোর্ট। কাজেই রিপোর্ট ভুল এমন মনে করারও কারণ নেই। তারপরও রিপোর্ট রিপিট করা হয়েছে আরেকটি বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এবং এই রিপোর্টও একই রকম। সেদিন ওই উদ্বিগ্ন দাদাকে এহেন রিপোর্টের কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমি দিয়ে আসতে পারিনি। হালে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর পড়তে গিয়ে পুরোনো কথাটি আবার মনে পড়ে গেল।
বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, রক্ত আমাশায় আক্রান্ত আমাদের দেশের শিশুদের একটা বড় অংশেরই এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কার্যকর কিছু অ্যান্টিবায়োটিকে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই সব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে তাদের রোগ নিরাময়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাদের সুস্থ করতে হলে ব্যবহার করতে হবে আরও আধুনিক এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক।
আমরা যারা কয়েক দশক ধরে চিকিৎসা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের কাছে এই বিষয় একেবারেই নতুন নয়। গত শতাব্দীর শেষের দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমরা যখন ইন্টার্নশিপ করছি, তখন বাজারে সিপ্রোফ্লক্সাসিন (Ciprofloxacin)-এর আমদানি।
আমার মনে আছে মেডিসিনে যার কাছে আমার হাতেখড়ি, সেই প্রয়াত অধ্যাপক গনি স্যার কী ভীষণ উৎসাহিত ছিলেন এই অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে। তার উৎসাহের কারণ ছিল আর কিছুই না, অসাধারণ এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে আমরা সেই সময় আমাদের ওয়ার্ডগুলোয় অনেক মুমূর্ষু রোগী সারিয়ে তুলতে পারছিলাম।
ইন্টার্নশিপ শেষে তৎকালীন আইপিজিএমআর-এর করিডোরে হাঁটাহাঁটি করতে করতেই দেখলাম সিপ্রোফ্লক্সাসিনের অকাল বিদায় এবং সেফট্রিয়াক্সোন (Ceftriaxone)-এর আমদানি। আর হেপাটোলজিতে শেষ যখন লিভার বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডাক্তারি করছি তখন চোখের সামনেই সেফট্রিয়াক্সোনের বিধায় ঘণ্টাও বাজতে দেখেছি।
শুরু হলো মেরোপেনেম (Meropenem)-এর জয়জয়কার। ইদানীং মনে হচ্ছে সেই মেরুপেনামের বিদায়ের ঘণ্টা বাজতেও বোধ করি আর বেশি দেরি নেই। আইসিইউতে রাউন্ডে গেলেই দেখি রোগীদের মেরুপেনামের সাথে আরও এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
অন্যথায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না শরীরে ছড়িয়ে পড়া ইনফেকশন এবং তাতেও কুল রক্ষা হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই। অনেকগুলো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও আমাদের অসহায়ভাবে আত্নসমর্পণ করতে হচ্ছে সেপটিসেমিয়ার জন্য দায়ী কোনো অচেনা জীবাণুর কাছে।
পাশাপাশি ইদানীং ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা একের পর এক যে নিত্যনতুন অ্যান্টিবায়োটিকের কাগজ চেম্বারে এসে ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, সেসবের ব্যবহার তো দূরে থাক নাম মনে রাখাই আমার মতো পঞ্চাশোর্ধ্ব বিশেষজ্ঞর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আইসিইউতে রাউন্ডে গিয়ে অচেনা সব নামীদামি অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার দেখে মাঝেসাঝেই কী করব আর বলব ঠিকঠাক মতো বুঝে উঠতে পারি না। তবে এতটুকু ভালোই বুঝি যে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’।
নিশ্চিত ভাবেই আগামীর দিনগুলো আরও খারাপ হতে যাচ্ছে। কারণ এর মানেই হচ্ছে সামনে আমাদের আরও অনেক বেয়ারা জীবাণুর মুখোমুখি হতে হবে যারা আমাদের কঠিনের চেয়ে কঠিন অ্যান্টিবায়োটিকগুলো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমাদের প্রিয়জনদের অসময়ে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। আর এখন যখন শিশুরাও এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের চক্করে পড়ে যাচ্ছে, তখন সামনের দিনগুলো যে আমাদের জন্য কোনো সুসংবাদ নিয়ে আসতে যাচ্ছে না, সেটাতো বলাই বাহুল্য।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় আমাদের সরকারের অনেকগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই সংকট মোকাবিলায় আছে আলাদা অপারেশনাল প্ল্যান। হাসপাতালে হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিকের রেশনাল ব্যবহারের উপর নিয়মিত সভা-সেমিনার আর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কোন হাসপাতালে, কোন পরিস্থিতিতে, কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে কমিয়ে আনতে হবে হাসপাতালের ভর্তি রোগীদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে কঠিন কোন জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যাকে আমরা আমাদের ভাষায় বলি নজোক্রমিয়াল ইনফেকশন (Nosocomial Infection), সেসব নিয়েও কাজ হচ্ছে বিস্তর।
তবে সমস্যা হচ্ছে এই সমস্যার কারণটা কিন্তু শুধুমাত্র মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাপক এবং ইরেশনাল প্রয়োগই নয়, পাশাপাশি আমরা আমাদের পোলট্রি ফিড আর গবাদি পশুর খাদ্য তালিকা থেকে শুরু করে আমাদের ফসলের মাঠগুলোয় কী ধরনের ওষুধ আর রাসায়নিক প্রয়োগ করছি তার সাথেও পুরো বিষয়টি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
এসব নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতার কথাও আমরা জানি যা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। তবে সবচেয়ে যা আশা জাগানিয়া তা হলো বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রীর নজরদারিতে আছে।
কাজেই রাতারাতি পরিবর্তন না এলেও, পরিবর্তন যে আসবেই তা বলাই বাহুল্য। তবে ওই পর্যন্ত আর ওই সময়টাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ আর সচেতনতার ভূমিকাটাও অনস্বীকার্য। নচেৎ বলা যায় না সেই সুদিন আসার আগেই যেমন আমাদের কাঁদিয়েছে কোভিড, আগামীকাল হয়তো কাঁদাবে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স কোনো ব্যাকটেরিয়া।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল); ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।