ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: চলতি বছরের জুলাইয়ে গত ৬ মাসের রেকর্ড ভেঙ্গেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বুধবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৩৬৬ জন।এর মধ্যে শুধু জুলাই মাসের রোগী ১২৭৭ জন। যা গত ৬ মাসের মোট আক্রান্তের অর্ধেক। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। চলিত বছরের মোট ৮ জনের ৭ জন মারা গেছে জুলাই মাসে।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বুলেটিনে জানানো হয়, গত এক দিনে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৬১ জন।
এর আগে গতকাল (২৬ জুলাই) ৯৯ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এই মৌসুমে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, জুলাইয়ের চেয়ে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি। এই ধরনের আবহাওয়া এডিস মশার প্রজননের জন্য সহায়ক। ফলে ২০১৯ সালের ন্যায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সবচেয়ে রোগী ভর্তি আছে।
এই হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুগদা, মান্ডা বাসাবো এসব এলাকার রোগী বেশী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চেয়ে ব্যবস্থাপনা সে বিষয়ে আমরা সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক যারা আছেন তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আমরা অব্যাহত রেখেছি।
তিনি বলেন, মৌসুম চলাকালে এবং শুরু হওয়ার আগে দুটি সার্ভে করা হয়েছে। এসকল সার্ভের সকল তথ্য-উপাত্ত আমরা সিটি করপোরেশনের কাছে শেয়ার করেছি। সে তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে উনারা কাজ করছেন।
চলতি মাসের ৩ এপ্রিল প্রকাশিত জরিপে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২১ জন কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গঠিত দল ১০ দিনে এই জরিপে দুই সিটির ৯৮ টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৫০টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ১৪৩টি বাড়িতে তারা এডিসের লার্ভা পাওয়া পায়। বাড়িতে লার্ভা শনাক্তের হার ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
জরিপে মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে দক্ষিণ সিটিতে। বিশেষ করে ৪৫ (ডিষ্ট্রিলারী রোড, দীন নাথ সেন রোড, রজনী চৌধুরী রোড), ৩৮ (কাপ্তান বাজার, মুচীপাড়া, নবাবপুর রোড) আর ৪০ নম্বর ওয়ার্ড (দয়াগঞ্জ জেলেপাড়া, স্বামীবাগ, বসু বাজার লেন) সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অন্য দুটিতে ২০ ও ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ করে।
অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ মশার ঘনত্ব ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া বাকি ওয়ার্ডে ১০ শতাংশের আশপাশেই রয়েছে।
এসব এলাকায় পরিত্যক্ত কনটেইনারে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া জলমগ্ন মেঝে ও প্লাস্টিক কনটেইনারে বেশি মাত্রায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
বুধবার ভোক্তা কণ্ঠের সাথে আলাপকালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগে. জেনা. মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, অত্যাধুনিক ড্রোন সার্ভে কার্যক্রম চলমান আছে। এর ফলে প্রতিটি বাড়ির ছাদে না উঠেই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে মশার উৎস সম্পর্কে।
এছাড়াও ওয়াশার পানির মিটার এবং এজাতীয় অন্যান্য স্থানে প্রতিমাসে প্রথম সপ্তাহে দানাদার কীটনাশক নোভালুরন প্রয়োগ করা হচ্ছে। মশার প্রজনন স্থান হিসেবে চিহ্নিত সকল নালা, নর্দমা এবং জলাশয়ে নিয়মিত গাপ্পি মাছ ছাড়া হচ্ছে। এদিকে নির্মাণাধীন ভবনে নিয়মিত লার্ভিসাইডিং করা হচ্ছে। এছাড়া ভবন মালিক এবং নিমার্ণ শ্রমিকদেরকে জমে থাকা পানিতে কেরোশিন তেল প্রয়োগ এর পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার স্থান এবং ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য বা ডেঙ্গু সম্পর্কিত যেকোনো অভিযোগের জন্য কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। যেকোনো পরামর্শ নিতে পারবেন: ০১৭৬৯-১০০৬৮০, ০১৭১৬-৫০৬২৫৮, ০১৭১৫-২৩৮৭৫৪, ০১৭১৫-৪৫৬৬৯৮, ০১৭৫৬-২০৯৪৮২, ০১৭১৬-৩৯৮৮৮৬, ০১৭৩৫-৮৪৩৬৯৩ নাম্বারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, ব্যাক্তিপর্যায়ে লার্ভা ধ্বংস করার জন্য আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। ১০টি অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার করা হচ্ছে। আমরা কেউ বসে নাই। লিফলেট, এল ই ডি স্ক্রিন, টেলিভিশনের মাধ্যমে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করছি।
ডেঙ্গুর জ্বরের সময়কাল
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। এই সময়ে প্রায় বৃষ্টি হয় ফলে, ফুলের টব, পরিত্যক্ত ক্যান, টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট এই রকম পরিত্যক্ত যেকোনো জিনিসের মধ্যে অল্প অল্প বৃষ্টির পানি বিক্ষিপ্তভাবে জমে যাবে। মুলত এসবে এডিস মশার বিস্তার ঘটে।
এডিস মশা কখন কামড়ায়
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে। তবে এই মশা কখনও অন্ধকারে কামড়ায় না।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
হঠাৎ করে জ্বর। শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি-১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। গলা ব্যথা, চরম অবসন্নতা এবং বিষাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে। অরুচি, বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে। রোগীর চোখ লাল হতে পারে এবং ত্বকও লাল হতে পারে। জ্বর ৩-৭ দিন স্থায়ী হয়। শরীরের চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হয়।
ডেঙ্গু জ্বর কাদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
আক্রান্ত হতে পারেন যে কোন বয়সের মানুষ। তবে নবজাতক, স্থূল স্বাস্থ্যের অধিকারী, গর্ভবতী নারী, ঋতুবতী নারী, পেপটিক আলসার, থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রক্তরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগী, দীর্ঘমেয়াদে যকৃৎ ও কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি, দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড ও ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহারকারী এই রোগের নানা জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
কী লক্ষণ দেখলে হাসপাতালে যেতে হবে
জ্বর কমার প্রথম দিন রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি। বার বার বমি/ মুখে তরল খাবার খেতে না পারা।
পেটে তীব্র ব্যথা। শরীর মুখ বেশি দুর্বল অথবা নিস্তেজ হয়ে পড়া/হঠাৎ করে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া
শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া/শরীর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।
প্রতিকার ও করণীয়
ঘুমানোর সময় বিশেষত বিকেল ও রাতে মশারি খাটিয়ে ঘুমানো। মশা যাতে কামড়াতে না পারে সে জন্য গায়ে ও পরার কাপড়ে মশক নিবারক ক্রিমের ব্যবহার কিংবা প্রয়োজনে লম্বা হাতওয়ালা শার্ট ও ফুলপ্যান্টসহ মোজা পরিধান,
প্রয়োজনে বাড়িতে মশার প্রবেশ নিয়ন্ত্রণকল্পে বাড়ির সব জানালা, ভেন্টিলেটর মশা অনভিগম্য জালক বা স্ক্রিনের ব্যবহার।
গৃহস্থালির আশপাশে পড়ে থাকা পানি জমার বিভিন্ন আধার যেমন- টিনের ক্যান, পরিত্যক্ত টায়ার, অব্যবহৃত পানির পাত্র, সেপটিক ট্যাংক, এয়ারকুলার প্রভৃতিতে যাতে পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। প্রয়োজনে উপরোক্ত আবর্জনাগুলো অপসারণের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রয়োজনে পানির ট্যাংক, হাউজ কিংবা ম্যানহোলের গর্তগুলো উপযুক্ত মশক অনভিগম্য ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যাতে পানির আধারের পানিগুলো এডিস মশার বংশবিস্তারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে।
ফুলের টব বা ফুলদানিতে জমে থাকা পানি প্রতি তিন দিন অন্তর ফেলে দিতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপজঙ্গল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।