ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দামও। সাধারণ কোম্পানিগুলোর চেয়ে নামিদামি ওষুধ কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ছোটখাট ফার্মেসি থেকে শুরু করে রাজধানীর বড় বড় ফার্মেসিতে জ্বর, ঠান্ডা থেকে শুরু করে প্রেসার, ভিটামিন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ প্রায় ওষুধের দামে একেবারে লাগামহীন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানা গেছে।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে যতটা আলোচনায় আসে, ওষুধের দাম বাড়লে ততটা আলোচনায় না আসায় নীরবে নাগালের বাইরে চলে গেছে ওষুধের দাম।
ভুক্তভোগী ক্রেতাদের অভিযোগ, নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে না বাড়ছে মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করা ওষুধের দাম তার চেয়ে বেশি বাড়ছে।
বিভিন্ন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে ওষুধের বাড়তি দামের এমনই ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রেসারের (উচ্চ রক্তচাপ) ওষুধের দাম খুবই বেড়েছে। ওসারটিলের দাম আগে ছিল ৮০ টাকা পাতা, বর্তমানে ১০০ টাকা। এভাবে ৮০ টাকার নজেলক ১০০ টাকা, ৬০ টাকার লোসারভা ৮০ টাকা, ৬০ টাকার ফিক্সকার্ড ৮০ টাকা, ৯৮ টাকার সিলডিপ-৫ হয়েছে ১১২ টাকা, ১২৬ টাকার সিলডিপ-১০ হয়েছে ১৪০ টাকা। এক পাতা বিসলল (৫ এমজি) ট্যাবলেট ১৩০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা হয়েছে। এভাবে অরবাপিনসহ প্রেসারের প্রায় সব ওষুধের দাম বেড়েই যাচ্ছে।
অধিকাংশ মানুষের গ্যাস্ট্রিকের জন্য ওষুধের দরকার হয়। দাম বাড়ার দিক থেকে পিছিয়ে নেই সেটিও। প্রতি পিস ফিনিক্স (২০ এমজি) ট্যাবলেট পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকা, ওমিডন (১০ এমজি) ট্যাবলেট তিন টাকা থেকে চার টাকা, পাঁচ টাকার ওমেফ ছয় টাকা ও ছয় টাকার প্যান্টোনিক্স সাত টাকা হয়েছে। ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ন্যাপ্রোসিন প্লাস ২০ এমজি+ ৩৭৫ এমজি ট্যাবলেট ১৬ টাকা থেকে ২০ টাকা হয়েছে।
বিক্রেতারা বলেন, ক্যালসিয়ামের দামও বহুগুণ বেড়ে গেছে। আগে ২১০ টাকা ক্যালবোডি বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ২৪০ টাকা, ২৪০ টাকার রেনোভিট হয়ে গেছে ২৭০ টাকা, ২৪০ টাকার বোস্ট ২৭০ টাকা, ৩০০ টাকার ক্যালবোরাল-ডি ৩৩০ টাকা হয়ে গেছে। ক্যালসিয়ামের এক কৌটা নিউরো-বি ট্যাবলেটের দাম ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা হয়েছে। এসব ওষুধের কমিশনও কম। তাই লাভও কম হচ্ছে। কিন্তু ক্রেতাদের ক্ষোভের কথা শুনতে হচ্ছে।
কোন কোন ওষুধের দাম বাড়ছে জানতে চাইলে একজন ফার্মেসী মালিক বলেন, ধান, চাল, সবজির চেয়ে ওষুধের দাম ইচ্ছামতো বাড়াচ্ছে কোম্পানি। করোনার পর থেকেই এভাবে কয়েক মাস যেতে না যেতে বেড়েই যাচ্ছে ওষুধের দাম। রোগীরা খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে তাজ ফার্মেসির আব্দুর রহিম বলেন, কয়েক মাস পর পরই বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ছে। দেখা গেছে আগের লটের ওষুধ শেষ না হতেই নতুন করে বাড়তি দামের ওষুধ বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।
সোলাইম্যান নামে এক ক্রেতা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আগে তিন/চার পাতা ওষুধ কিনতে ৩০০ টাকা লাগত। বর্তমানে ৪০০ টাকাতেও জোটে না। এতো বেশি দাম কেন? কি হয়েছে যে ওষুধের দাম এত বেশি বাড়ছে? এটা কি দেখার কেউ নেই?
শুধু এই ফার্মেসিতে নয়, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে ঠাকুরগাঁও ফার্মেসিসহ অন্যান্য ফার্মেসির বিক্রেতাদেরও অভিযোগ, করোনার পর থেকে ওষুধের দাম বাড়ছেই। কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে।
ফার্মেসি মালিকরা জানান, অপারেশনের পর পরই অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয়। এই ওষুধের দামও লাগামহীন হয়ে পড়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেফোটিল প্লাস (৫০০ এমজি) ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা পিস হয়ে গেছে। ৫০ টাকার সেকোক্লাব ৬০ টাকা, ৩৫ টাকার অ্যাজিথ্রোমাইসিন ৪৫ টাকা, ৩৫ টাকার জিম্যাক্স ৪০ টাকা, ৫০ টাকার সেফথ্রি ৬০ টাকা পিস হয়ে গেছে। মক্সাসিলিন (১০০ মিলি) সিরাপ ৪৭ টাকা থেকে ৭০ টাকা হয়েছে।
তারা আরও বলেন, শিশুদের নাকের অ্যান্টাজল ০০. ৫% ড্রপ ১১ টাকা থেকে ১৯ টাকা ও প্রাপ্ত বয়স্কদের নাকের অ্যান্টাজল ০.১% ড্রপ ১১ টাকা থেকে ২০ টাকা করা হয়েছে। আমাশয় রোগীদের পেটের সমস্যায় ব্যবহৃত প্রতি পিস প্রোবায়ো ক্যাপসুল ১৪ টাকা থেকে ২৫ টাকা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, ডায়াবেটিসের জন্য প্রতি পিস কমপ্রিট (৪০ এমজি) ট্যাবলেট সাত টাকা থেকে আট টাকা হয়েছে। কাশির তুসকা প্লাস (১০০ মিলি) সিরাপ ৮০ টাকা থেকে ৮৫ টাকা এবং ফেক্সো (৫০ মিলি) সিরাপ ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা করা হয়েছে।
জ্বর, ব্যথার জন্য অতি সাধারণ নাম নাপার দামও ১০ থেকে ১২ টাকা পাতা হয়ে গেছে। এছাড়া শিশুদের জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত নাপা ড্রপ ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা করা হয়েছে। নাপা সিরাপ (৬০ মিলি) ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা হয়েছে।
এছাড়া, এলার্জির প্রতি পিস ফেনাডিন (১২০ এমজি) ট্যাবলেট আট থেকে নয় টাকা করা হয়েছে। শিশুদের জিংক সিরাপ (১০০ মিলি) ৩৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা ও শিশুদের পেট ফাঁপা ও হজম শক্তির চিকিৎসায় ব্যবহৃত নও-নেহাল সিরাপ ৬০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় মোনাস ১০ ট্যাবলেট ১২ টাকা থেকে ১৬ টাকা হয়েছে। ২০০ এমজির ডপজিবা ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা পাতা, ৪০০ এমজি ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা হয়ে গেছে। একই ভাবে ডকোপার দামও ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা ও ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা হয়ে গেছে।
শুধু ওষুধের দামই নয় জরুরি অস্ত্রোপচার কক্ষে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব ও পেসমেকারসহ বিভিন্ন মেডিকেল ডিভাইসের দামও অনেক বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির উপদেষ্টা ও জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মোমেনুল হক বলেন, ‘ডলারের কারণে সব ওষুধের দাম বাড়ছে। কারণ দেখা গেছে, ৮৭ টাকা ডলার ১১০ টাকা হয়ে গেছে। আমাদের সব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এছাড়া অন্যান্য জিনিসের দামও বেড়েছে। তাই আমাদের ওষুধের দাম বাড়াতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ইচ্ছামতো ওষুধের দাম বাড়াই না। আমরা যুক্তি দেখিয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করি। ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা নিত্যপণ্যের দাম ঠিক করে। আর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কাজেই আমরা বলব ইচ্ছামতো বাড়ানো হচ্ছে না। বাজারে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নির্ধারিত দামে ভোক্তাদের কাছে ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপপরিচালক ডা. আইয়ুব বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে ১১৭টি ওষুধের এমআরপি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে ওষুধ কোম্পানি দাম বৃদ্ধির জন্য আবেদন করলে ৫৩টি পণ্যের দাম বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দাম নির্ধারণে সরকারের দুটি কমিটি করা হয়েছে। তারা প্যাকেজিং মূল্যসহ সব দিক বিবেচনা করে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সচিবের নেতৃত্বে সরকার নিয়ন্ত্রিত টেকনিক্যাল কমিটি দাম নির্ধারণ করে। তা হিসাব নিকাশ করেই করা হয়।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ডা. আইয়ুব বলেন, ‘এটা বিশেষ পণ্য। তাই আলোচনা সভা করে দাম নির্ধারণ করা হয় না। সংশ্লিষ্টদের নিয়েই টেকনিক্যাল কমিটি দাম নির্ধারণ করে।’