করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যে অস্বাভাবিক মাত্রায় মানসিক অসুস্থতার প্রবণতা লক্ষ্য করছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে শুচিবাই বা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি)। আবার করোনা নিয়ে সবসময় আতঙ্কে মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ভয়। অপরিচিত কাউকে দেখলেই দৌড়ে ঘরে গিয়ে পালানোর প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে।
চট্টগ্রামের মনোরোগ চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মানসিক সমস্যার এই প্রবণতা কেবল করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যেই নয়, অন্য অনেক রোগীর মধ্যেও অনেকটা একই ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক বিভাগের বহির্বিভাগে এসব রোগীর বিস্তর দেখা মিলছে। দেখা মিলছে আরও জটিল রোগীরও।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, করোনায় ভুগে তাদের অনেকের মধ্যে রোগটি আরও জটিল রূপ নিচ্ছে। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পরও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগী শারীরিক না হলেও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন। চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় একে বলা হয় পোস্ট কোভিড সিনড্রোম। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে তা মানুষের শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে— যার ফলে উদ্বেগ, অবসাদ ও অনিদ্রার মত মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন লালখানবাজারের বাঘঘোনা এলাকার বাসিন্দা রিনা চৌধুরী। রিনার স্বামী সাদেক জানান, আগে থেকেই রিনার পরিস্কার-বাতিক ছিল। ময়লা আবর্জনা দেখতে পারত না। ধোয়া কাপড়-থালাবাসন বারবার পরিস্কার করতো। কিন্তু রোগটা শুরু হওয়ার পর থেকে সারাদিন ময়লা-আবর্জনা ঘাটতে থাকেন। আর এসে সারাদিন গোসল করেন। তখন থেকেই এ অসুখ শুরু।
চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভেতরের বেডে শুয়ে থাকতে দেখা গেল রাঙ্গুনিয়ার সিহাবকে। সিহাবের মা জানান, ছেলে করোনার আগে জেএসসি পরীক্ষার প্রি-টেস্টে নম্বর কম পায়। সিহাবের বাবা ছেলেকে বকা দেন। মারধরও করেন। সেই থেকে ছেলেটি আমার ভয় পেয়ে ঘরদোর বন্ধ করে থাকত। কারো সাথে কথা বলত না। একপর্যায়ে সে খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দেয়। খাবার দেখলেই বলে খাবারে বিষ মেশানো আছে। সিহাবের মা তাছলিমা আফসোস করে বলেন, করোনার কারণে সেই পরীক্ষাটা হলোই না। শুধু আমার ছেলেটা পাগল হয়ে গেল।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. পঞ্চানন আচার্য্য চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, কোভিডের পর রোগীদের মধ্যে তিনটি প্রবণতা বেড়ে গেছে। যেমন— দুশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতা. পিডিএসডি (পোস্ট ক্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার), অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসঅর্ডার অর্থাৎ শুচিবাই (ওসিডি)। আর সচরাচর মানসিক রোগীদের যে সমস্যা থাকে তা হলো সিজোফ্রোনিয়া, বাইনোকোলার, ডিজঅর্ডার, ডিপ্রেশন।
পিটিএসডির কথা বলতে এই চিকিৎসক বলেন, এটা এমন ধরনের রোগ যাতে অবসেশন অথবা কমপালশন বা দুটিই থাকতে পারে। অবসেশন এক ধরনের মর্মপীড়াদায়ক চিন্তা, ছবি অথবা তাড়না— যা মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথায় আসে। এই চিন্তাভাবনাগুলো বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয় এবং কোনো যুক্তির ধার ধারে না।
আবার করোনাকালে রোগের ভয় থেকে অস্বাভাবিক সচেতনতার কারণে এনজাইটিস ডিসঅর্ডার বা দুশ্চিন্তা থেকে শুচিবাই রোগ বেড়েছে।
চমেক হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের বহির্বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তারিক আবেদীন বলেন, সাধারণত মানসিক রোগ বলতে আমরা বুঝি, শরীরের মতো মনের কোনো অসুস্থতা। কিন্তু মানসিক রোগ হচ্ছে এক বা একাধিক উপসর্গের সমষ্টি। চমেক হাসপাতালের মনোরোগ ওয়ার্ডে সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগী বেশি আসে। এসব রোগীদের অনেকেরই দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
মূলত স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা হতাশা, বিষণ্নতা থেকেই মনোরোগের উৎপত্তি। অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার, ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মনোযোগের বিক্ষিপ্ততা, হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার, বুলিমিয়া, যৌনবিকৃতি এবং সিজোফ্রোনিয়া সমস্যা নিয়ে রোগীদের ওয়ার্ডে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হতে হাসপাতালে দুই থেকে তিন মাসও রাখা হয়।