ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: অতি প্রচলিত এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যগত সমস্যা ‘গ্যাসট্রাইটিস’। লোকমুখে যা গ্যাস্ট্রিক নামে পরিচিত। বর্তমানে খুব কম মানুষ আছেন যারা এ রোগে ভুগছেন না। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই এই সমস্যা মহামারী আকার ধারণ করেছে।
আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির মতে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই গ্যাসট্রাইটিস সমস্যায় ভুগছেন।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত পাঁচ বছর বিক্রিত ওষুধ শীর্ষ তালিকায় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। ২০১৭ সালে যেখানে বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকার ওষুধ, সেখানে সর্বশেষ গত বছর বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা।অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে দেশে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
ভোক্তাকণ্ঠের পক্ষ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি দোকান ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, প্রেসক্রিপশন ছাড়া মানুষ কোন ধরনের ওষুধ বেশি কিনতে আসেন। তারা জানান, প্রেসক্রিপশন ছাড়া সাধারণত মানুষ যে সকল ওষুধ কিনতে আসেন এরমধ্যে অন্যতম গ্যাস্ট্রিক জাতীয় ওষুধ ও নাপা।
নির্বিচারে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করছে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ
নির্বিচারে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করছে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ
নির্বিচারে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করছে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ
নির্বিচারে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করছে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ
চিকিৎসকরা বলছেন, যারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যখন তখন গ্যাস্ট্রিকের ঔষুধ সেবন করছেন তারা নিজের অজান্তেই শরীরের সর্বনাশ ডেকে আনছেন। এতে হাড় ক্ষয় থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
গ্যাসট্রাইটিস সমস্যা নিয়ে ভোক্তাকণ্ঠের পক্ষ থেকে কথা হয়েছে, বিএসএমএমইউ-এর গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলমের সঙ্গে।
ভোক্তাকণ্ঠঃ গ্যাস্ট্রিক বলতে কি বুঝায় এবং এটি কেনো হয়?
অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলমঃ গ্যাস্ট্রিক কথাটা শুদ্ধ কথা নয়।পাকস্থলী, ইংরেজিতে Stomach মানব দেহে পরিপাকতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা অন্ননালী ও ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যে অবস্থিত।
এই পাকস্থলী সংক্রান্ত যে কোন অবস্থা বা রোগকে সাধারণত আমরা গ্যাস্টিক বলে থাকি। যেমন, পাকস্থলীর আলসার হলে তাকে গ্যাস্টিক আলসার বলি। আবার পাকস্থলীর ক্যান্সার হলে তাকে গ্যাস্টিক ক্যান্সার থাকি।
এর লক্ষণগুলো হলোঃ পাকস্থলীতে অতিরিক্ত বা ভারসাম্যহীন এসিড উৎপন্ন হবার ফলে, পেটের উপরের অংশে ব্যথা বা জ্বালা পোড়া অনুভূত, বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাস, বমিভাব, টক ঢেঁকুর, মুখে দুর্গন্ধ, পেট ফাঁপা, ক্ষুধামন্দা, অল্প খেলেই ভরপেট অনুভব, ওজন হ্রাস,পিঠে ও বুকে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য অভ্যাসের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে।
আর এ রোগের অন্যতম কারণ পেটের ভেতর এক ধরনের জীবানুর প্রবেশ। যেটি পানি বা খাবারে থাকে।
আমাদের দেশে হাইজিন বা পরিষ্কার পরিছন্নতা ওইভাবে খেয়াল করা হয় না। অনেকে খোলা পানি পান বা ওয়াসার পানি সরাসরি পান করে থাকেন। যা জীবানু মুক্ত নয়।
অনেকে হোটেল বা ফাস্ট ফুডের দোকানের খাবার খেয়ে থাকেন, যেখানে দীর্ঘদিনের পুরা তেল ব্যবহার করা হয়, খাদ্য উপাদান গুলোর সঠিক মান পরিক্ষা করা হয় না। এছাড়া অনেকে ঘরেও অতিরিক্ত তেলেভাজা খাবার বা অতিরিক্ত ঝাল-মসলা জাতীয় খাবার খেয়ে থাকেন। যার ফলে পাকস্থলীর সমস্যা দেখা দেয়।
ভোক্তাকণ্ঠ: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্যাস্টিকের ওষুধ সেবন করলে, শারীরিকভাবে কি কি ক্ষতি হতে পারে ?
অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলম : প্রথমত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ সেবন উচিত নয়। কারন প্রতিটা ওষুধ ক্যামিক্যাল প্লান্টের তৈরি করা বস্তু। সুতরাং, কিছু না কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকেই।
আমাদের দেশের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ সরাসরি কোন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ গ্রহন করছে।
স্বল্প মাত্রায় স্বল্প সময়ে হয়তো এটি সমস্যা হয় না। তবে দীর্ঘ সময় এভাবে ওষুধের ব্যবহার করতে থাকলে এটি শরীরে বিভিন্ন রোগ তৈরি করতে পারে। এতে কিডনির ক্ষতি হয়, ব্রেনের স্মৃতি লোপ পাওয়া থেকে ডিমেনশিয়া জাতীয় রোগ হতে পারে। পেটে ইনফেকশন হতে থাকে।
সারা পৃথিবীর গবেষণায় এটা প্রামাণিত হচ্ছে যে, দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবনের ফলে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার জাতীয় রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
পাকস্থলীর যে এসিড এটা আমাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ বা জীবানু প্রতিরোধে এটি অন্যতম একটা উপায় হিসেবে কাজ করে। একজন রোগী যখন খুব বেশি মাত্রায় গ্যাস্ট্রিক ওষুধ সেবন করে তখন এই এসিড ধমন হতে থাকে। তখন স্বাভাবিকভাবেই রোগ জীবানু পাকস্থলী পার হয়ে অন্তের মধ্যে ঢুকে যায় এবং পেটের ভিতরে বিভিন্ন ইনফেকশন তৈরি করে।
তিনি বলেন, যারা চিকিৎসক নয়, বিভিন্ন ফার্মেসিতে কাজ করেন বা পল্লী চিকিৎসক রয়েছেন তারা অজ্ঞানতাবশত বা ভুল ধারনায় অনেক সময় গ্যাস্ট্রিক ওষুধ দিয়ে থাকেন। ফলে উপকার না হয়ে ক্ষতি বেশি হয়।
অনেক সময় রোগীরা বলে থাকেন, ডাক্তার সাহেব আমিতো ৪০ পাওয়ারে ওষুধ খাই এতেও গ্যাস কন্ট্রোল হয় না। আমাদের বুঝতে হবে, তার গ্যাস কন্ট্রোল না হওয়ার কারন এসিডিটি তো নয় বরং অন্য কারণে। সেখানে প্রয়োজন অন্য চিকিৎসা অন্য পরামর্শ।
ভোক্তাকণ্ঠঃ পাকস্থলীর গ্যাস্টিক বা আলসার জাতীয় রোগ থেকে মুক্তি পেতে করণীয় কি?
অধ্যাপক ডা.রাজিবুল আলমঃ পাকস্থলীর গ্যাস্টিক বা আলসার জাতীয় রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিষ্কার-পরিছন্নতা সঙ্গে ফোটানো পানি ছাড়া খাবেন না। এক কথায় বাচঁতে হলে বাইরের খাবার পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে বাসায় অতিরিক্ত মশলাযুক্ত বা তৈলাক্ত খাবার খাবার না খাওয়া।
সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। খালি পেটে চা,কফি গ্রহণ করবেন না। ধুমপান,মাদকদ্রব্য ও অ্যালকোহল বর্জন করুন। যত্রতত্র ব্যথার ঔষুধ (NASIDs), খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে যা শরীরকে টক্সিন মুক্ত রাখে। ঘুমাতে হবে ঠিকঠাক, মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে। রাতের খাবার ঘুমানোর অন্তত ২ঘন্টা আগে সেরে ফেলুন।