ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: একজন মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক মাত্রা ৫০-৬০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এলাকায় সার্বক্ষণিক শব্দের মাত্রা গড়ে ১০০ ডেসিবেলের ওপরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোন জায়গায় যদি শব্দের মাত্রা ১০০ ডেসিবেলের ওপরে থাকে তাহলে সেখানে ১৫ মিনিটের বেশি অবস্থান করা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়, আগামী পাঁচ বছরে এই শহরের এক তৃতীয়াংশ মানুষ শ্রবণশক্তি হারাবে।
শব্দ দূষণের এই বিরূপ প্রভাব শুধু মানুষের উপর পড়ছে না। একদিকে পশু-পাখি, কীটপতঙ্গও বংশবিস্তার করতে পারছে না অন্যদিকে কমেছে ফসল উৎপাদন।
চিকিৎসকরা বলছেন, তীব্র মাত্রায় শব্দ দূষণের ফলে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, আলসার, মাথা ব্যথাসহ নানা ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু। আর এসব রোগীদের বেশির ভাগ নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত।
রাজধানীর ধানমণ্ডি, বাংলামোটর, শাহবাগ, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ট্রাফিক পুলিশ, চালক, পথচারী ও ফুটপাতের দোকান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয় ভোক্তাকণ্ঠের।
তারা বলছেন, বিভিন্ন রাস্তার মোড়গুলোতে সিগন্যালের সময় বেশি হর্ন বাজিয়ে থাকে। বিশেষ করে সিগন্যাল ছাড়ার সময় একসঙ্গে হর্ন বাজায় গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি গাড়ি। আর তীব্র শব্দের ফলে কানে কম শোনা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ, মাথা ব্যথাসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম হলো কথা বা শব্দ। কিন্তু এ শব্দ যখন আমাদের কানের ইন্দ্রিয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে তখন আমরা এটা শব্দ দূষণ বলে থাকি।’
শব্দের মাত্রা একটা নিদিষ্ট লেবেল পর্যন্ত পৌঁছালে আমরা যেমন শুনতে পাই। আবার সেটি যখন নির্দিষ্ট লেবেল অতিক্রম করলে সেটি আমাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
সাধারণ শব্দের মাত্রা ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেল হলে আমাদের জন্য ভালো। এই মাত্রায় একজন মানুষ ৮ থেকে ১০ ঘন্টা অতিবাহিত করতে পারে। তবে ঘুমানোর জন্য শব্দের মাত্রা ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেলের বেশি না হলেই ভালো।
কোন জায়গায় যদি ৬০ থেকে ৭০ ডেসিবেল শব্দ উৎপন্ন হয় তাহলে সেখানে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা, ৮০ ডেসিবেল হলে চার ঘন্টা, ৯০ ডেসিবেল হলে দুই ঘন্টা আর ১০০ ডেসিবেলের ওপরে হলে ১৫ মিনিটের বেশি সময় থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি যান চলাচলের এমন ১০টি লোকেশনে দেখা গেছে- ২৪ ঘন্টার মধ্যে অধিকাংশ সময় শব্দের মাত্রা ১০০ ডেসিবেলের ওপরে থাকে। বিশেষ করে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে, আব্দুল্লাহপুর, মিরপুর ১০, গুলশান- ২, শাহবাগ এলাকায় অধিকাংশ সময় ১০০ ডেসিবেলের ওপরে থাকে। এগুলোকে যদিও আমরা বাণিজ্য এলাকা বা মিশ্র এলাকা বলে থাকি। এসব এলাকার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক যে শব্দের মাত্রার কথা বলা হয়েছে এর চেয়ে দুই থেকে তিন গুন শব্দ পরিলক্ষিত হয়।
তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণা অনুযায়ী, এসব শব্দের অন্যতম উৎস হলো গাড়ির হর্ন। এর বাইরে নির্মাণ কাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার। শব্দ দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ, রাস্তার পাশের দোকানী শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা।’
জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অডিওলজী বিভাগের প্রধান ডা. জোনায়েদ রহিম বলেন, ‘শব্দ দূষণের ফলে মানুষ বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লম্বা সময় অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকার কারণে হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথা ব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কান।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে সাধারণত যেসব রোগী আসেন তাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি। বেশি আসে কানের ইনফেকশন, জন্মগত ভাবে যাদের সমস্যা, এছাড়া বয়স্করা আসে যারা কানে শোনে না। এরপর শব্দ দূষণের সমস্যা থেকে কিছু রোগী আসে। এছাড়া কিছু রোগী আছে যারা অতিরিক্ত ড্রাগ সেবন ফলে সমস্যায় ভুগছেন। যাদের শিশু জন্ম নেওয়ার পর থেকে কানে শুনতে পায় না। তাদের শুরু থেকে চিকিৎসা করলে অনেকটা সেড়ে উঠে।’
ড. জোনায়েদ রহিম বলেন, ‘অতিরিক্ত শব্দের কারণে কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে মানুষ ধীরে ধীরে শ্রবণ শক্তি হারাতে থাকে। কত ডেসিবেল শব্দে আপনি কতটুকু সময় কাটাচ্ছেন তার উপর বিষয়টি নির্ভর করে। ১২০ ডেসিবেল শব্দ সঙ্গেই সঙ্গে কান নষ্ট করে দিতে পারে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোন ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে তাহলে তাহলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে। এ সমস্যার শুরুতেই মানুষ সচেতন হলে কানের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে।’
শব্দ দূষণের বিষয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে কি বলা আছে?
বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় বলা আছে, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণ কাজের যে সকল যন্ত্র বা মেশিনারিজ শব্দ দূষণ হয় এর ব্যবহার বন্ধ থাকবে।
- আবাসিক এলাকায় ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না।
- আবদ্ধ কোন স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
- আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা হবে ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল।’
- হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে।
- শব্দ দূষণে দোষী হিসেবে প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুই ধরনের দণ্ডই প্রদান করার বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেয়ার কথা বলা রয়েছে।
- আপনি শব্দ দূষণের শিকার এমন মনে হলে টেলিফোনে, লিখিত অথবা মৌখিক ভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রতিকার চাইতে পারেন।