ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ভেঙ্গে ভয়ংকর রুপ নিচ্ছে ডেঙ্গু। মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত রোগীর কারণে শয্যা খালি নেই। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে খরচের চাপে পিষ্ট হচ্ছেন রোগীরা।
রাজধানীর কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ এত বাড়ছে যে, অন্য রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে ফেরত যাচ্ছেন। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরাও ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে এক নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, রোগীর চিকিৎসায় চিকিৎসকদের অবহেলাও রয়েছে। আসন না থাকায় মেঝেতে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে রোগীদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সরকারি ২০টি হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন এক হাজার ৫০০ জন। বেসরকারি ৩৩টি হাসপাতালে ভর্তি এক হাজার ২৫৫ জন।
জানা গেছে, রাজধানীর অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের তুলনায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড হাসপাতাল), শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নির্ধারিত ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসছেন। এভাবে রোগী বাড়লে সামনে পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও ওয়ার্ড বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। তাই ডেঙ্গু নিয়ে সামনে আরেকটা বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত প্রতিবেদেনে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকির এলাকার পরিধি বেড়েছে। ২০১৯ সালে যেখানে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছিল রাজধানীর ৩০ শতাংশ, এবার তা বেড়ে হয়েছে ৫০ শতাংশ। রাজধানীর প্রায় সব বাসিন্দাই ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিতে। আর জরিপের আওতাভুক্ত ৯৮ ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যা না পেয়ে অনেকে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগী ও স্বজনদের ভিড়ে এই ওয়ার্ডের ভেতরে চলাফেরা করাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দাতেও বেশ কিছু শয্যা পাতা হয়েছে। সেখানেও যাদের জায়গা হয়নি, তারা মেঝেতে ফোমের তোশক বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।
এই হাসপাতাল ভবনের চারটি তলায় এখন শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের তৃতীয় তলায় নারী, অষ্টম তলায় শিশু এবং দশম ও একাদশ তলায় রাখা হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের। শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৮১। এর মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশু রয়েছে ১২৩ জন। বিপরীতে শিশু ওয়ার্ডে শয্যা আছে মাত্র ৬০টি। অন্যান্য তলাতেও রোগীর তুলনায় শয্যা কম।
এই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। শয্যা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতাল থেকে স্যালাইন, ক্যানোলা, মাইক্রোপোর ও স্যালাইনের সঙ্গে যুক্ত নল দেওয়া হচ্ছে না। ভর্তির সময়ই বলে দেওয়া হয়, হাসপাতাল থেকে শুধু একবার স্যালাইন দেওয়া হবে। এরপর যা স্যালাইন লাগবে, সেটা বাইরে থেকে কেনা লাগবে। এছাড়া অব্যবস্থাপনা তো রয়েছেই।
হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘এ বছরের শুরুতে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও গত মাস থেকে হঠাৎ করে তা বেড়েছে। এখন যে হারে এটি বাড়ছে এবং ছড়াচ্ছে, এটি আমাদের জন্য অবশ্যই ভয়ের কারণ। এবার যারা আসছে তাদের অধিকাংশই দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত। ক্লাসিক ডেঙ্গুর যে উপসর্গগুলো আমরা জানতাম, দ্বিতীয় দফায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যতিক্রম হচ্ছে। জ্বর ও মাথা ব্যথার সঙ্গে পেট ও বুকের ব্যথা দেখা যাচ্ছে। ব্যথার পরিমাণ এত বেশি যে মনে হচ্ছে শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাচ্ছে। ডেঙ্গু এখন সব জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে। এখন আর নির্দিষ্ট কোনো এলাকা থেকে রোগী আসছে না। সারা ঢাকা শহর থেকেই রোগী আসছে। এমনকি ঢাকার বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী ভর্তি হচ্ছে।’
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। রোগীদের প্রথমে দুটো বা তিনটা স্যালাইন দেওয়া হয়। কিন্তু যে রোগীর ছয়টা স্যালাইন লাগবে, সেটা দিতে পারব না। কারণ, প্রতিদিন প্রায় ৮০০ ব্যাগ স্যালাইন দিতে হচ্ছে। বরাদ্দ আনলিমিটেড না। বরাদ্দের বিপরীতে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিনিয়তই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর লাগাম টানা জরুরি, আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়ার আগে পরিকল্পিত ভাবে এর প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।’
একই চিত্র দেখা যায় শিশু হাসপাতালেও। ডেঙ্গু রোগীর চাপে সেখানেও শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। ভর্তি হতে না পেরে অনেক রোগীর স্বজনরা তাদের শিশুদের নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ‘শিশুদের আইসিইউ সাপোর্ট পিআইসিইউ ও এইচডিইউতেও শয্যা খালি নেই। বাধ্য হয়েই অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
জানা গেছে, হাসপাতালের ডেঙ্গুর ৪২টি শয্যার সবগুলোতেই রোগী ভর্তি আছে। শয্যা সংকটে হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, সরকারি হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অনেকেই ছুটছেন বেসরকারি হাসপাতালে। তবে সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে খরচ অনেক বেশি।
জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় রোগীদের ওষুধপত্র, বিভিন্ন পরীক্ষা, খাওয়া দাওয়াসহ খরচ হচ্ছে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। একই চিকিৎসায় বেসরকারি হাসপাতালে খরচ পড়ছে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। বেসরকারি বড় হাসপাতালে গেলে খরচ আরও বেশি।
রাজধানীর বেসরকারি আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগে চিকিৎসা নেওয়া এক রোগীর স্বজন মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই হাসপাতালে শয্যা ভাড়া পাঁচ হাজার টাকার বেশি। এছাড়া বিভিন্ন টেস্ট করতে হয়েছে। ওষুধ, টেস্ট এবং শয্যা ভাড়াসহ এক লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে।’
রাজধানীর ধানমণ্ডির ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের খরচ আরও বেশি বলে জানা গেছে। এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১০ হাজার টাকা, কেবিনে ডাবল বেড থাকলে প্রতি বেড ভাড়া প্রায় পাঁচ হাজার টাকা, ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের টেস্ট এবং বেড ভাড়ায় প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু জ্বর মূলত এডিস ইজিপ্টি মশার কামড়ে হয়। তবে সব মশার কামড়ে এ জ্বর হয় না। এই মশা তখনই ক্ষতিকর হবে যখন এই মশা ডেঙ্গু জ্বরে সংক্রমিত কোনো ব্যক্তিকে কামড় দেবে। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস তখন এই মশা বহন করবে এবং এই মশা যখন কোনো সুস্থ মানুষকে কামড় দেবে তখন ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন।
ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত এবং হাসপাতালে ভর্তির পেছনে অন্যতম কারণ হলো আবহাওয়ার তারতম্য, সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশার বংশ বিস্তার রোধের সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া এবং সর্বোপরি সচেতনতার অভাব।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং মৃত্যু কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র প্রফেসর ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকে জানেন না কখন রোগ পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষা না করে তারা বসে থাকেন। অনেকে জ্বর হলে পাত্তা দেন না বা আমলে নেন না। অনেকে হাতুড়ে চিকিৎসক বা ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খান। এসব কারণে রোগ ভালো হয় না, তারা শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসেন। এটাই বেশি মৃত্যুর কারণ।’
এদিকে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গু কর্ণার চালু করা হয়েছে। একইসঙ্গে মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে।
শুধু রাজধানীতেই নয়, ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলাতেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চট্টগ্রামে এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত (শনিবার) মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩০৩ জনে এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ১৪ জনে।
রাজশাহীতে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭১ জন রোগী। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪৮ জন।
এছাড়া, অন্যান্য জেলাতেও ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সরকারি বড় হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ জন।
-এসআর