ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ভেষজ, হার্বাল, আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও অর্গানিকসহ নানা নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ক্ষতিকর ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস।
যেগুলো তৈরিতে নেই কোনো অনুমোদন। মানা হচ্ছে না চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো নিয়ম-কানুন। ‘শতভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ও বিফলে মূল্য ফেরতে’র ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকের সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছে জীবনঘনিষ্ঠ এসব ভুয়া পণ্য।
ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে নকল ও ভেজাল পণ্য সেবনে অসংখ্য মানুষ শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এক রোগ সারাতে গিয়ে তারা আরও নতুন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বেশ কিছুদিন ধরে যুগান্তরের পক্ষ থেকে ফেসবুকের বেশ কয়েকটি পেজ অনুসরণ করে ভেষজ ওষুধসহ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদনহীন পণ্য বিক্রির সত্যতা মিলেছে। ওষুধজাতীয় এসব পণ্য মার্কেটিং করার পন্থাও বের করেছে তারা। একেকজন বিশেষজ্ঞ সেজে পেজে এসে পরামর্শ দিচ্ছেন। বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিক বাজারজাতের আগে মানবদেহে কতটুকু মাত্রায় কার্যকর, ফলাফল পেতে কতটুকু পরিমাণ ব্যবহার করা যাবে এ বিষয়ে গবেষণা জরুরি। মানবদেহে প্রয়োগের আগে প্রাণীদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দরকার। একইসঙ্গে ওষুধ প্রস্তুতকারক ও গবেষকদের চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে বৈধ সনদ থাকতে হবে। সবশেষ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের ওষুধ সামগ্রী বাজারজাত করা যাবে না।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বর্তমানে ফেসবুকে এ ধরনের সহস্রাধিক পেজ রয়েছে। এর মধ্যে যেসব পেজে বেশি ভিউ বা গ্রাহকের নজর বেশি সে ধরনের অনেকগুলো পেজ শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে একেকটি পেজ একেক ধরনের পণ্য বিক্রি করছে। পিউর ট্রাস্ট পেজে বিক্রি হচ্ছে জন্ডিসের ওষুধ। খাঁটি টিম, ন্যাচারাল নিউট্রি ফুড, আস-শিফা অর্গানিক ও ন্যাচারাল ফ্রেশ নামক পেজে ডায়াবেটিস, লিভার, হাড়ক্ষয়, দৃষ্টিশক্তি, জ্বর, কাশি ঠাণ্ডা, কোষ্ঠকাঠিন্য, কোলেস্টেরল, ওজন কমানো ও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় শজনে পাতার গুঁড়া বিক্রি হচ্ছে।
ন্যাচার পাওয়ার পেজে ‘নেচার গোল্ড রেমিডি বা ফুড সাপ্লিমেন্ট নামে একটি ভেষজ ওষুধ সেবনে শরীরের কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারিড নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ব্লক, জন্মগত হার্টের ব্লক, ঘাড়ের ধমনিতে ব্লক, ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস ও রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব বলে বিক্রি করা হচ্ছে। কেউ কিনতে না চাইলে ঘরে বসে তৈরি করে খেতে পারেন বলেও প্রচার করা হচ্ছে।
‘নিউট্রাল কেয়ার, লাইফ কেয়ার বিডি গুডস ও পিআইডি বডি, সুরক্ষা বিডি পেজে’ শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে সব ধরনের শারীরিক ব্যথা দূর করতে ‘পেইন গার্ড ফুড সাপ্লিমেন্ট’ ও ‘পেইন গার্ড অয়েল’ বিক্রি করছে। ‘ডাক্তার বাড়ি’ পেজে পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, বদহজম, বুক-গলা জ্বালাপোড়া, পেপটিক আলসার, গ্যাস্ট্রিক, আইবিএস ও পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা সমাধানে ‘গ্যাস্ট্রিক কিউর পাউডার-১’, ভেষজ কেয়ার নামক পেজে ‘গ্যাস্ট্রি মিক্স’, এনার্জি ফর লাইফ বিডি পেজে ‘গ্যাস্ট্রোনীল রেমিডি পাউডার’ বিক্রি করা হচ্ছে।
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, রক্তশূন্যতা, হজমে গোলযোগ সমাধান, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ও শারীরিক বৃদ্ধি ছাড়াও উজ্জ্বল ত্বকের জন্য সেবা ফুডস পেজে ‘সুপার ফুড বিট পাউডার’ বিক্রি হচ্ছে। দাঁদ, চুলকানি, ত্বকের ফাঙ্গাস, সোরিয়াসিস ও কোল্ড এলার্জি চিকিৎসায় জয় মার্টের তৈরি ‘হারবাল সোরিয়াসিস অয়েন্টমেন্ট’, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাকেন্দ্র ও ন্যাচারাল ভেষজের তৈরি এলার্জি কেয়ার রেমিডি এবং অর্গানিক চর্ম সল্যুশন ও গ্লেজ মার্ট বিডি পেজে বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। পাইলস ও ফিস্টুলার চিকিৎসায় স্বদেশ অর্শ্ব পাইলস সেন্টারে ভেষজ ট্যাবলেট বিক্রি করা হচ্ছে। চুল পড়া, নতুন চুল ও দাড়ি গজাতে তিশা অ্যান্ড তোহা হেয়ার অয়েল এবং রিপ্লেসমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল পেজে নন-সার্জিক্যাল পদ্ধতিতে টাক সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। এসব ফেসবুক পেজে রোগীদের যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর, বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা অফিসের ঠিকানা ছাড়াও কুরিয়ারের মাধ্যমে রোগীর বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে। দ্রুত রোগমুক্তির আশায় একশ্রেণির মানুষ সেগুলো কিনে খাচ্ছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে ২৩২টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৫৪টি ইউনানি, ১৬৪টি আর্য়ুবেদিক, ৫৩টি হোমিও এবং ৩৬টি হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ৫১ হাজার ৩২৫ ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করছে। বর্তমানে রেজিস্টার্ড ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় দুই লাখ পাঁচ হাজার ৫৮৯টি। এসব ওষুধ দেশের চাহিদার ৯৮ ভাগ জোগান দিয়ে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি করছে। ওষুধের বর্তমান বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ওষুধের বাজারের বড় একটি অংশ ভেষজ ওষুধের নিয়ন্ত্রণে। যারা প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরির নামে কোনো ধরনের ল্যাব টেস্ট ছাড়াই ঘরোয়া ভাবে তৈরি করছে। অনিয়ন্ত্রিত মাত্রা ও পরিমাণে বিভিন্ন উপাদান মেশাচ্ছে। সংরক্ষণের জন্য সঠিক তাপমাত্রা কোল্ড বা চেইন পদ্ধতি মানছে না। উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। রোগীদের আকৃষ্ট করতে প্রচারপত্র বিলি, কেবল অপারেটরে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ খুলে বিভিন্ন নামে বিক্রি করছে।
যেমন- হাঁপানির ওষুধে উচ্চমাত্রায় স্টেরয়েড, মোটা হওয়ার ওষুধে পেরিএকটিন, যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধির ওষুধে সিল্ডেনা সাইট্রেট, ত্বক ফর্সার ক্রিমে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ব্যবহার করছে। কিন্তু স্টেরয়েড জীবনরক্ষাকারী উপাদান হলেও অতিরিক্ত মাত্রায় জীবন বিপন্ন হয়। সিল্ডেনা সাইট্রেট ‘ভায়াগ্রা’ তৈরির একটি উপাদান, যা দেশে নিষিদ্ধ। পেরিএকটিন সাধারণত ব্যবহার হয় গরু মোটাতাজা করতে। এটি মানুষের কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় বিক্রির ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বেছে নেওয়া হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, হারবাল মেডিসিন থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান ওষুধ বানায়। কিন্তু সেটা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। স্বীকৃত ওষুধ বিজ্ঞানে ইউনানি আয়ুর্বেদিক পড়ানো হয় না। শুধু হারবাল বা ভেষজই নয়, প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিও ফেসবুকে ক্যাম্পেইন করে ওষুধ বিক্রি করতে পারে না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বলেন, গত ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘ওষুধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩’ পাশ হয়েছে। আইন অনুসারে কেউ ফেসবুক, ওয়েবসাইট ইন্টারনেট মিডিয়ায় লাইসেন্স ছাড়া বিজ্ঞাপন আকারে ওষুধের প্রচার করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ জন্য সাত লাখ টাকা জরিমানা এবং পাঁচ বছরের জেলের বিধান রয়েছে। আইনটা নতুন, অনেকে জানে না। এ জন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মিটিং করা হচ্ছে। অধিদপ্তর এটি নিয়ে ব্যপকভাবে কাজ করছে। এরপরও কেউ কেউ যদি প্রমাণসহ অধিদপ্তরকে জানায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সৌজন্যে, যুগান্তর।