মো. আবদুল কাদেরঃ
দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ভোক্তাদের উপর। সারাদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বেড়েই চলছে, যা ভোক্তাদের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে৷
শুধু কি আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশে বাড়ছে, নাকি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ। তাহলে দেশি উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন?
নিয়মিত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম।
এলপিজি বৃদ্ধির কারণ কি এবং এতে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বলে মনে করছেন?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: এলপিজির দাম বৃদ্ধির পিছনে অনেকগুলো অসঙ্গতি রয়েছে। এলপিজির মূল্য নির্ধারণনীতি একটি সংস্কৃতি। দীর্ঘ ১০-১১ বছর যাবৎ এলপিজির কোম্পানিগুলো নিজেরাই মূল্য নির্ধারণ করে আসছিলো। এখন হাইকোর্টের নির্দেশে গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে বিইআরসি নির্ধারণ করে আসছে। আন্তর্জাতিক বাজারের মূলনীতি অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করছে প্রতি মাসে। প্রতি মাসে মূল্য নির্ধারণে আমাদের আপত্তি থাকায়, এর প্রতিবাদ স্বরূপ, এই মূল্য নির্ধারণের অনুষ্ঠানে আমরা অংশ গ্রহণ করছি না।
আন্তর্জাতিক বাজারে যে মাসে মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, সে মাসে দেশে মূল্য নির্ধারণ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, আন্তর্জাতিক বাজারে যে মাসে মূল্য পরিবর্তন হচ্ছে, সে পণ্য আমাদের দেশের বাজারে পৌঁছাতে এক থেকে দেড় মাস সময় লেগে যায়। লিকুইড ফুয়েলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাজারে ৪৫ দিনের পণ্য মজুদ রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য নীতি থেকেও আমরা ঠকছি। কারণ, গত মাসের আমদানিকৃত এলপিজি এখনো বাজারে বিদ্যমান। পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য পরিবর্তনের এক মাস পর দেশের মূল্য পরিবর্তন হতো। কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। যার ফলে, ভোক্তারা ঠকছে।
আমি মনে করি, কখন কোন সময়টাতে আমদানি করতে হবে, কোম্পানিগুলোর মজুদ রাখার ক্ষমতা কতটুকু বাধ্যতামূলক, তাদের আমদানিকৃত অথবা মজুদকৃত পণ্যের আমদানিতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ হওয়া উচিৎ। এরকম একটি প্রক্রিয়ায় আমাদের আশা হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের বাজারেও মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে। কিন্তু আমদানি বাবদ যে ব্যয় সংযোজন হয়ে মূল্য নির্ধারণ হচ্ছে। সে সংযোজিত ব্যয় যৌক্তিক এবং ন্যায্য কিনা সে বিষয়েও আমাদের পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
আমরা কিছু আপত্তি দিয়েছি। যেমন, জাহাজ ভাড়া। প্রতি মেট্রিক টনের জন্য জাহাজ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮ ডলার, অন্যদিকে ভারত আমদানি করে ২০ ডলারে। আমরা কমার্শিয়াল ইনভয়েস এ দেখিয়েছি কোনো কোনো কোম্পানির ৬৯ ডলার ব্যয় হচ্ছে। তাদেরকে বলেছি কমার্শিয়ালি ইনভয়েসদের ডাটা সংগ্রহ করেন। ভারত থেকেও সংগ্রহ করুন। দেখুন, কারা কত টাকা জাহাজ ভাড়া দিচ্ছে। সব মিলিয়ে ২৮ থেকে ২৯টি কোম্পানির মধ্য থেকে তারা ১২টি কোম্পানির জমা নিয়েছে। কিন্তু তাও আবার কমার্শিয়াল ইনভয়েস নয়। তারা সেগুলো সঠিক কিনা তাও যাচাই-বাছাই করেনি এবং সবার মূল্য হারও নেওয়া হয়নি। আমরা যেটা জমা দিয়েছি ৬৯ ডলার, সে কোম্পানিও তাদের মধ্যে নেই। ১২টি কোম্পানি যে ইনভয়েস জমা দিয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে তারা ভাড়া ৯৮ ডলার নির্ধারণ করেছে। এটা যথাযথ হয়নি।
ডিস্ট্রিবিউশন এবং ট্রান্সপোর্টেসনের ক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে ২য় বারই, তখন প্রায় ৫৯ টাকা সমন্বয় করা হয়েছিল প্রতি সিলিন্ডারে। প্রথম যেটা ছিলো, তাতেও বেশি ধরা হয়েছিলো। তখন মূল্য কম ছিলো বলে, এগুলো বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এতটা নাজুক অবস্থায় ছিলাম না। এলপিজি ব্যবসার নতুন সংস্কৃতি হিসেবে মূল্য নির্ধারণ বিইআরসি করছে। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় অবস্থান দেখা হয়েছিলো।
তখন কোনো স্ট্যান্ডার্ড পিকচার তৈরি করে দেখানো হয়নি। কিন্তু এখন দেখানোর সময় হয়েছে। কোথায় কত টাকা ব্যয় হচ্ছে তা দেখানো উচিত। তা দেখিয়ে ৬০-৭০ টাকা অনায়াসে কামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করি। আমাদের এখানে ১হাজার ২৫৯ টাকা চলমান কালে ভারতে ৯০০ টাকার কমে বিক্রি হয়েছে। আমরা এগুলো লক্ষ্য করতে বলেছি। এখানে ভারত তাদের সাপ্লাইয়ে ১০০% ব্যাবহার করছে, আর আমরা চাহিদার তুলনায় দুই-তিন গুন বেশি আমদানি করতেছি। যার ফলে আমাদের সাপ্লাইয়ের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে সে দায় টা কেন ভোক্তাকে নিতে হবে। সেটা প্রশ্নটা এখন জরুরি।
কারণ, এগুলোতো কোম্পানির দক্ষতার উপর নির্ভর করছে। আমরা যদি তাদের জবাবদিহিতার আওতায় না নিয়ে আসি, তাহলে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে না৷ তাদের দক্ষতা ডেভেলপ হবে না, যা খরচ করা উচিত তার থেকে বেশি ওরা খরচ করছে। অন্য সকল বিষয়ে আমরা ভারতকে অনুসরণ করি কিংবা তাদের উদাহরণ টেনে এনে দেখায়, তাহলে এলপিজির ব্যাবসায় কেন আমরা তা ব্যাবহার করছি না।
দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, সাপ্লিমেন্টারী বাড়ছে, সরকার দুই স্তরে ভ্যাট বাড়ায়। এভাবে আমাদের ব্যয় বেড়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেসব পণ্য আমদানি করে, সেসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে, তারা সরকারের রাজস্ব কমিয়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখে। জ্বালানির মতো একটু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য যা বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তাতে এমনটা করা হবে না কেন! যেখানে উপশহরগুলোতে কিংবা বস্তিবাসীরা সবচেয়ে বেশি সিলিন্ডার ব্যাবহার করছেন।
অথচ বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যারা ০-৫০ ইউনিটের কম খরচ করে তাদের প্রতি ইউনিট ৩.৭৫ পয়সা রাখা হয়েছে। সরকারি সিলিন্ডার ৫৯৫ টাকা থেকে আরো কমিয়ে আনলেও সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমরা তা করছি না। কারণ, রাষ্ট্র এখন ব্যাবসা করতে চাই। সহযোগিতা নই। ব্যবসায়ীদের মতোই রাষ্ট্র এখন আরেকটা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা যেমন, আমাদের কাছ থেকে যেকোনো ভাবেই হোক মুনাফা নিতে চাই, সরকারও তেমনিভাবে আমাদের কাছ থেকে মুনাফা আয় করতে চাই। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি বিভাগ তার অন্যতম উদাহরণ।
দাম বৃদ্ধির হিড়িক থেকে বের হতে না পারলে, কেমন প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: উন্নত কৃষিমালা চর্চার নীতিমালা প্রণয়ণ এবং বাস্তবায়ন বিষয়ক একটি প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলাম। যেখানে আলোচনা হয়েছে, আমরা কৃষিতে যথেষ্ট উন্নতি করেছি। আমাদের উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে আমাদের বিজ্ঞানীরা অবদান রেখেছে। সবজি প্রায় ২কোটি মেট্রিকটন প্রতি বছর উৎপাদন করছি। মাথাপিছু হিসেবে প্রতিদিন ৫০০গ্রাম সবজি উৎপাদন করছি। এগুলো নিঃসন্দেহে আমাদের গর্বের বিষয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়, আলুর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়।
ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কি বলছেন?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রেও একই কথা৷ যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি পায়, তখন সরকারকে তৎপর হতে হবে, কিভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এক্ষেত্রে সরকারকে সচেতন হতে হবে৷ সবসময় বাজার তদারকিতে রাখতে হবে। এসব পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে তা ভোক্তাদের জন্য দেয়া হোক। আমাদের ১৫০টির উপরে প্রাইভেট এবং ৫০টার উপরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে সচেতনতামূলক কাজে ব্যাবহার করতে পারে। ফেসবুক ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা নিয়মিত বাজার তদারকি করবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কথা অনুযায়ী যখন চিকন চালের মূল্য ৩০ টাকার বেশি হওয়ার কথা না, তখনও মোটা চালই বিক্রি হচ্ছিলো ৫০টাকার উপরে৷ মূল্য বৃদ্ধি কিংবা মূল্য সংযোজন আমরা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। কৃষক পণ্যের যে দাম পায় আর ভোক্তা যে দামে বাজার থেকে ক্রয় করে, তা পণ্য বেদে অনেক সময় তিন-চার গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। তাহলে আমাদের শাসন ব্যবস্থা ব্যর্থ নয় কি! তারা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না৷ এধরণের তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের সহযোগিতা করতে পারে না। ভোক্তাদের এভাবে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।
বর্তমানে বাজার ব্যাবস্থা কর্তৃত্বপূর্ণ বাজার ব্যাবস্থা। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যাবস্থা রহিত হয়ে গিয়েছে। বাজার সম্পূর্ণভাবে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। এই মুহুর্তে আমাদের করণীয় বিষয়টা কমিশন, ভোক্তা অধিকার অধিদফতর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা বাহিনী এদের সকলের সমন্বিত চেষ্টায় স্বাধীনভাবে এবং সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
আমরা একটি পরাধীন রাষ্ট্র থেকেও মর্মান্তিক জীবনযাপন করছি আর আমরা তা মেনেও নিচ্ছি। মেনে নিচ্ছি এই বলে যে বিধাতা যা করে! এবলে আমরা নিজেদের স্বন্তনা দিচ্ছি।
সরকারের প্রতি আমার প্রশ্ন, আমি যদি বাজার থেকে সেবা পণ্য ক্রয় না করি, তাহলে বাজারে সেবা পণ্য উৎপাদনকারী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান কি টিকে থাকবে? কোনো আমদানি বাণিজ্য কি চলবে? আমদানি বাণিজ্য না থাকলে আপনি শুল্ক পাবেন? আপনার সেবা যদি মানুষ না কিনে, তাহলে আপনার ৬লাখ কোটি টাকার বাজেটের টাকা কোথায় থেকে আসবে, কে দিবে আপনাকে? এই বাজেট ঘাটতি কি করে পূরণ করবেন?
আপনি ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক থেকে লোন নিবেন। ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে পড়বে, যার ফলে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে পারবে না৷ প্রবল সংকটে পড়বে। এই অবস্থা চলতে থাকলে, যে উন্নয়নের মহাসড়কে জাতি উঠে গেছে, সে উন্নয়নের তলায় মানুষের জীবন এবং জীবিকা পিষে মারা যাবে, সেটা চাপা পড়ে যাবে। তাহলে সে উন্নয়ন আমার কি কাজে লাগবে? সেই উন্নয়ন আমার সুস্বপ্ন নই, আমার দুঃখ স্বপ্ন।
আপনাদের মাধ্যমে আমি সরকারকে জানাতে চাই। তারা কি এই অবস্থাগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে, এগুলো নিয়ে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে চিন্তা করে দেখেছে, এসব জনগণেরই অংশ।
সেবা প্রধানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানুষ এখন শত্রু ভাবতে শুরু করেছে৷ বিদ্যুৎ, গ্যাস, কিংবা অন্য সকল সেবা প্রতিষ্ঠানকে মানুষ বন্ধু নয় বরং শত্রু ভাবে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছি, দেশ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে উন্নিত হয়েছে, যা পাকিস্তানও পারেনি কিন্তু তার পাশাপাশি যে অন্ধকার তৈরি করে আছি, তার বিষয়ে কতটুকু চিন্তা করেছি৷
দামের ঊর্ধ্বগতি কমানো যায় কিভাবে, ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো যাবে কিভাবে?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: উর্ধ্বগতি বিভিন্নভাবে কমানো যেতে পারে৷ পণ্য বা সেবার মূল্য কমে গেলে মানুষের ক্রয় বেড়ে যাবে। কৃষি খাতকে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, খাদ্য নিশ্চয়তা করার জন্য। খাদ্য নিশ্চয়তা না করলে, মানুষ অতীতের মতো দুর্ভিক্ষে পড়বে। যার ফলে, এই বিষয়টাকে আমরা বিশেষভাবে সুরক্ষিত করতে পেরেছি। কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে৷ এবারও একনেকে নতুন করে ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। আমি সরকারকে অভিনন্দন জানায়, এই বিষয়টাতে সরকার গুরুত্ব দিয়েছেন।
কৃষিকে এখন আর শিল্প খাত থেকে আলাদা করা যায় না। ফসল উঠানোর পর থেকে মানুষের ব্যাবহার উপযোগি করা পর্যন্ত যেসকল পদ্ধতি রয়েছে, যাকে পোস্ট হার্ভিস্টিং বলা হয়, যার মাধ্যমে আমরা মূল্য নির্ধারণ করার সুযোগ পেয়েছি। মৌসুমে প্রচুর পণ্য সরবরাহ করা হয়।
বিদ্যুৎ কিংবা জ্বালানি তেলের সাথে সবকিছু সম্পৃক্ত। বিদ্যুৎতের দাম বাড়লে, কৃষি খাতে ব্যায় বাড়বে, সারের দাম বাড়বে৷ একদিকে আপনি জ্বালানি কিংবা বিদ্যুৎতের মূল্য বৃদ্ধি করছেন, অন্যদিকে কৃষি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছেন এতে কোনোরকম ভালো ফলাফল পাচ্ছি না৷ আমাদের দেশের মতো, বিশ্বের অন্য কোথাও জ্বালানি খাত থেকে এত বেশি রাজস্ব আয় হচ্ছে না৷ আমরা একদিকে কৃষি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছি, অন্যদিকে জ্বালানি খাতকে ব্যাবসায় পরিণত করার জন্য সরকার একটি প্লেয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। জ্বালানি খাতকে যেভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে দাবিত করছে, ঠিক তেমনি কি খাদ্য বিভাগকে অনিশ্চয়তার দিকে দাবিত করছে না? এখনি এই সংঘাতকে চিহ্নিত করতে হবে, এবং এর সমাধানের পথ বের করতে হবে। এখনি যদি সমাধান করতে না পরি, তবে এই জাতি করুন পরিণতির শিকার হতে হবে৷ খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হতে বাধ্য।
মৌসুমেও দাম কমছে না। মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় বলা হচ্ছে, মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে দাম উর্ধ্বমূখী। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আড়ৎদার, মজুদদার এরা মৌসুমে মজুদ করে এবং এরাই মূলত দাম বাড়িয়ে তা বাজারে ছেড়ে দেয়৷ ভারসাম্যহীন করে তারা মুনাফা লুঠে নেয়। সুদখোরদের পাশাপাশি মুনাফাখোরদেরকেও একই অপরাধের অপরাধী, একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে। যখন আলুর দাম বেড়ে ৫০ টাকা হয়ে গেলো, তখন এরকম একটি প্রোগ্রামে আমরা বলেছিলাম, যারা মজুদ করেছে এবং তা বাজারে না ছেড়ে একটা সংকট সৃষ্টি করেছে। আপনারা ডিসিদের নির্দেশ দেন যে, যেখানে যত আলু মজুদ করে রাখা হয়েছে সবগুলোতে অভিযান চালিয়ে, আলু বাজারে ছেড়ে দেন। এটাই তাদের শাস্তি। কিন্তু সরকারতো এমনটা নির্দেশ দেয় নি৷ সরকার এমন অবস্থার কাছে নিজেকে জিম্মি করেছে, পাশাপাশি আমাদেরও জিম্মি করেছে৷ তাহলে সরকার কিভাবে এই দায় এড়িয়ে যায়।
সরকার আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে, নিজেও এর ভুক্তভোগী। তাহলে সরকার কেন, এসবের দায় এড়িয়ে যাবে। সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। ২০-২৫ বছর পূর্বে আলু মৌসুমের বাহিরে খুব একটা পাওয়া যেত না৷ কিন্তু বর্তমানে সবসময়ই পাওয়া যাচ্ছে। যার মূল কারণ, এই মজুদদার কিংবা আড়ৎদার। এটা যেমন ভালো দিক, তেমনি এতে ভোক্তারা যতটুকু না লাভবান হয়েছে তারচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে, মধ্যসত্ব্যভোগী ব্যবসায়ীরা৷ তারা এতে অসম্ভব মুনাফা, পাহাড় পরিমাণ মুনাফা তৈরি করে নিয়েছে। কেন তারা এই সুযোগটা পাচ্ছে, কেনই তাদের এই সুযোগটা দেওয়া হচ্ছে! যদি তারাই সংসদ সদস্য হয়, তারাই যদি মন্ত্রী হয়, তাহলে তারা তাদের স্বার্থ এবং তাদের সম্মৃদ্ধি, সুরক্ষাটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে নিশ্চিত করবেন এবং করছেন৷ তার মানে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের সংসদ, রাষ্ট্রের রাজনীতিকে এই স্বার্থ সংঘাত মুক্ত হতে হবে।
বাজার ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: অন্যান্য দেশের ন্যায়। দেশগুলোতে যে ব্যবস্থাটা রয়েছে, উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে, পরিবহন ব্যয় যোগ করে, ভোক্তার কাছে একটি পণ্য পৌছাবে৷ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই মূল্যটা যথাসময়ে সঠিকভাবে নির্ধারণ করে তা সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করবে এবং সে অনুযায়ে বিক্রি হবে। সে অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে কি না সেটা পুঙ্খানো পুঙ্খভাবে, স্বচ্ছতার সাথে নজরদারির আওতায় আনতে হবে এবং সেখানে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, তাহলে এই সকল অব্যবস্থা হতে পারে।
এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ নজর রাখতে হবে। যেখানে পণ্য উৎপাদন হচ্ছে এবং যেখানে বিক্রি হচ্ছে তার মাঝখানে অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো কি কি ঘটছে!
পরিবহনগুলোকে কয়েকটা ধাপে চাঁদা দিতে হয় এবং এক্ষেত্রে পুলিশও চাঁদা আদায় করে। ‘যে রক্ষক, সে নিজেই ভক্ষক’ এমন প্রচুর শিরোনাম আমরা টেলিভিশনে, খবরের কাগজে দেখেছি৷ ছোট ছোট খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়, যেটা সংগ্রহ করে পুলিশ এবং এলাকার নেতা নামক কিছু মাস্তান। এই মাস্তানদের ক্ষমতার উৎস রাজনীতিবিদ। তাহলে এসকল জায়গাগুলোর সমস্যা বা সংকট নিষ্পত্তি করতে হলে রাজনীতিকে সুস্থ করতে হবে৷ যেটা এখন অসুস্থ৷
মানুষকে তার অধিকার আদায়ের জন্য সচেতন হতে হবে। যেটা আমরা করছি৷ আমরা মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করি। ভোক্তাদের সজাগ এবং সচেতন থাকতে হবে৷
যার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
– রেগুলেটরি অথরিটি যেমন, বিইআরসিকে স্বাধীনভাবে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, নূন্যতম ব্যয়ে যাতে ভোক্তারা জ্বালানি পেতে পারে সে অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক দাম, সঠিক মাপ, এবং সঠিক মান ঠিক করবে। কিন্তু সেটা সে করতে পারছে না বা করছে না।
– আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে৷ আইনের আওতায় সকল প্রতিষ্ঠান, সকল ব্যক্তি সমান এই মান-দণ্ড নিশ্চিত হতে হবে। সকলকেই বিচারের আওতায় আসতে হবে, জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে।
– আমলাদের কর্তৃত্ব, সরকারের কর্তৃত্ব আর আমলাদের কর্তৃত্ব আলাদা হয়ে গিয়েছে। সরকারের জ্বালানি খাতে যে সকল কোম্পানি আমাদের সেবা দিচ্ছে, সেগুলো ব্যবসায়ীক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যার মাধ্যমে এই প্রশাসনটা চালাচ্ছে। কিন্তু সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো প্রশাসনের জায়গাগুলোতে যদি বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে সেটা নজরদারির দায়িত্ব তাদের। প্রতিকারের দায়িত্বও তাদের প্রতিবিধানের দায়িত্বও তাদের।
তারাই যদি প্রশাসনের দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে নিয়ে নেই, তাহলে এই রেগুলেটরি দায়িত্ব পালনে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, অকার্যকর হয়ে পড়ে। জ্বালানি বিভাগ এই রেগুলেটরি দায়িত্ব পালনে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। আইন-কানুন, পলিসি ঠিকমত চলছে কিনা তা তারা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে যেসকল চুরি, চাঁদাবাজি কিংবা অন্য সকল অনিয়মের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়েছে।
কারণ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর মালিক এই সকল সরকারি কর্মকর্তারা৷ তারা এ সকল কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান হয়ে বসে আসে৷ সুতরাং, কোম্পানিগুলো যেসব অনিয়ম করছে, তার সাথে এই সকল আমলারাও জড়িত।
– বিদ্যুতের সাথেও একই রকম কাহিনী ঘটছে। ভুতুড়ে বিল করে আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে, তারা বোর্ড গঠন করলো, কিন্তু তার প্রতিকার তারা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্যাব বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে, কোন কোম্পানি ঐমাসে কত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু তারা এটা বের করলো না৷ এগুলোকে সুশৃঙ্খলায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রথমত আমলাদের সম্পৃক্ততা দূর করতে হবে। এবং তাদেরকে ক্ষমতার সঠিক ব্যাবহার করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। তাহলে তারা এসমস্ত কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতার পর্যায়ে আনার যে দায়িত্ব, সেটা তারা যথাযথভাবে পালন করতে পারবে। অর্থাৎ তাদেরকে স্বার্থ সংঘাত মুক্ত করতে হবে৷
– খাদ্য নিরাপত্তার মতোই জ্বালানি নিরাপত্তাকে দেখতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে। এবং অবশ্যই তাকে বানিজ্যিক খাতে পরিণত করা যাবে না। তাকে সম্পূর্ণরুপে সেবামূলক খাতে রাখতে হবে। সরকার এখান থেকে রাজস্ব আহরণের নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাতে যদি সরকারের উন্নয়ন ধীর হয়ে যায়, তা হতে দিন। তার মধ্যে কল্যান নিহিত আছে।
এই খাতে ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়ে কি বলবেন?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: এখানে অবশ্যই আপনাকে ভর্তুকি দিতে হবে। বিদ্যুৎ যেভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে স্বল্প মূল্যে দিচ্ছেন, তার সঠিক ব্যাবহারও নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এই খাতেও আপনাকে ভর্তুকি দিতে হবে।
ব্যাবসায়িক রাজনীতিবিদ আমরা চাই না। আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনীতি করে এমন রাজনীতিবিদ চাই৷ যিনি জন সাধারণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। যিনি জনসাধারণের মাথার মধ্য মনি হয়ে থাকবে। জিনি সাধারণ মানুষের কথা ভাববেন, চিন্তা করবেন, তাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। তবেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজনীতিকে আমরা রোগ মুক্ত দেখতে চাই৷ তারা মানুষের জন্য কাজ করুক। তারা ভালো কিছু খাওয়ার পূর্বে আমার না খেয়ে থাকার কথা চিন্তা করবে। যদি এমন রাজনীতিবিদ পেতে পারি তবেই এত এত সরকারি লোকবলেরও প্রয়োজন হবে না। সবকিছু স্বাভাবিক হতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না৷
সামনে রমজান উপলক্ষে টিসিবির পণ্যকে আপনাকে কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম: টিসিবির পণ্য এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে৷ যা আমার দৃষ্টিতে জাতীয় জীবনের দূর্ভাগ্য। আমাদের দেশের জন্মলগ্নে টিসিবি অপরিহার্য ছিলো। আজকে আমাদের সক্ষমতা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। টিসিবির প্রয়োজন হতো না, যদি এসব দুর্ভোগে আমরা না পড়তাম। উপরোল্লিখিত এ সমস্ত অশুভ শক্তি যদি আমাদেরকে বঞ্চিত না করতো।
সুতরাং টিসিবির বিষয়টি এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় কম পণ্য সরবরাহ করা। ঢাকা শহর অথবা বড় বড় শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, এই বিষয়গুলো আরও বেশি বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। রমজান মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র মাস। এটা পূণ্যের মাস। এমাসে আমাদের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্তরের সাধারণ মানুষদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকে। এ মানুষগুলো যদি এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না৷ তারপরও বলবো টিসিবির পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। অঞ্চল কেন্দ্রিক সুবিধা বাড়াতে হবে।
সরকার আমাদের ছাত্রদের কাজে লাগাতে পারে। ছাত্রদের হাতে আপনি নির্ভয়ে যেকোনো কিছু ছেড়ে দিতে পারেন৷ দূর্নীতি মুক্ত করার জন্য সরকার যদি ছাত্রদের হাতে ছেড়ে দেয়, ২৪ ঘন্টার মধ্যে তার সমাধান হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। ছাত্ররা এটা পূর্বেও প্রমাণ করেছে। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য সরকার তা করছে না৷ কেন করছে না তা আমার জানা নেই।
আরইউ