ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:
নিত্যপণ্যের বাজার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। চাল, ডাল, তেলসহ সব ধরনের পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বিপদে পড়তে হচ্ছে সীমিত বা নিম্ন আয়ের মানুষকে। দেশে সব ধরনের ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে।
সামনে রমজান মাস। রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে এখন থেকেই কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে—এ বিষয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান,
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব
কালের কণ্ঠ : দ্রব্যমূল্য কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। ধানের মৌসুমেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে। এর কারণ কী?
গোলাম রহমান : সাধারণভাবে বলা হয় প্রতিযোগিতা থাকলে সরবরাহ ও চাহিদা দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে। বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন কারণে বাড়তে ও কমতে পারে। চালের উত্পাদন বেড়েছে, জনসংখ্যাও বেড়েছে। খাদ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও পশুখাদ্য প্রস্তুতেও চাল ব্যবহূত হচ্ছে। দেশে উত্পাদিত চালে দেশের চাহিদা মিটছে না। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। উত্পাদন ব্যয় বাড়ায় ধানের দাম বেড়েছে। দেশের প্রতিটি মোকামে চালের মূল্য নির্ধারণে বড় মিলাররা বিশেষ ভূমিকা রাখেন। অধিক মুনাফা অর্জনের প্রবণতা থেকেও চালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া চাহিদা অনমনীয়, সামান্য সরবরাহ ঘাটতিতেই চালের মূল্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও চালের মূল্য প্রভাবিত হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। শুধুই কি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধি এর কারণ। নাকি নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে?
গোলাম রহমান : সরবরাহে ঘাটতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম এখন বেশ চড়া। একই সঙ্গে পরিবহনের জাহাজভাড়া বেড়েছে। ডলার-টাকার মূল্যহারের অবমূল্যায়নে টাকার অঙ্কে আমদানিমূল্য বেড়েছে। শতাংশ হিসাবে আরোপিত শুল্ক-করের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোজ্য তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র কয়েকটি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে একটি অলিগোপলি বা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।
কালের কণ্ঠ : এবার শীতের সবজির দামও বাড়তির দিকে ছিল। বলা হচ্ছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই বাজারে সবজির দাম কমে না। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কিভাবে কমানো যেতে পারে?
গোলাম রহমান : বাজারব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীরা একটা বিশেষ ভূমিকা রাখে। একমাত্র তাঁদের কারণে সবজির দাম বাড়ে—এমন ধারণা অতি সরলীকরণ বলে মনে করি। এবার সবজির দাম না কমার অন্যতম কারণ ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন ও উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধি। সবজি পচনশীল পণ্য। পচনশীলতা রোধে পরিবহনে এবং সংরক্ষণে হিমতাপবিশিষ্ট পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। কৃষক পর্যায়ে উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন আছে।
কালের কণ্ঠ : যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তখনই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়েছিল। সেই আশঙ্কাই কি সত্যি হলো?
গোলাম রহমান : জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পণ্যমূল্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সত্যি, তবে পণ্যমূল্যে বর্তমান লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির আরো অনেক কারণ আছে।
কালের কণ্ঠ : সামনে শবেবরাত, রোজা, ঈদ। আমরা দেখি রোজার আগে সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এবার কি আরো আগে থেকেই বাজারে তার প্রভাব পড়ল? বাজার কি নিয়ন্ত্রণে থাকবে? কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে?
গোলাম রহমান : আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে আছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তুলেছে। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি শুধু আসন্ন রমজান উপলক্ষে ঘটছে, এমনটা ভাবা সঠিক বলে মনে হয় না। মূল্য পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। টিসিবি এক কোটি পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে রোজার প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করবে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সরকারকে দেখতে হবে পণ্য সরবরাহ চেইন যাতে কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শুল্ক-কর সুসমীকরণের মাধ্যমে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। চাঁদাবাজিসহ সব অনৈতিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়াও প্রয়োজন। আর্থিক ও মুদ্রানীতির আওতায় জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। ভোক্তা-ক্রেতাদেরও সংযমী হতে হবে। রমজানের আগে এবং প্রথম দিকে বেশি বেশি পণ্য কেনার প্রবণতা দেখা যায়, যা ব্যবসায়ীদের পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে। সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক থাকলে পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি রোধ বহুলাংশে সম্ভব হবে।
কালের কণ্ঠ : বাজারে একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট সব সময় সক্রিয় বলে শোনা যায়। এই সিন্ডিকেট দমনে কি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়?
গোলাম রহমান : বাজারে প্রতিযোগিতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ থাকলে সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে পারে না। সরকারকে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে বাজারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশেষ বিশেষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মোট চাহিদার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে কোনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ক্রেতা-ভোক্তাদেরও সচেতন থাকতে হবে। ভোক্তার অস্বাভাবিক আচরণও বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। পণমূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ভোক্তাদের সংগঠিত ও প্রতিবাদী হওয়ারও প্রয়োজন আছে।
কালের কণ্ঠ : আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় কী কী ঘাটতি আছে? এই ঘাটতি পূরণে আমরা কী করতে পারি।
গোলাম রহমান : আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা করছি। এই ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার এবং ভোক্তাসহ সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষার কথা। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে আমরা এই ব্যবস্থার চর্চা করছি। কিন্তু প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে না ওঠায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি না হয়ে সংকুচিত হয়েছে এবং কিছু অতি নিত্যপণ্যের বাজার মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৫-২০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক ডিভিশন সৃষ্টি করার প্রয়োজন মনে করি। নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা একক কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিনিয়ত সরকারের গৃহীত নানা সিদ্ধান্ত ভোক্তাস্বার্থ প্রভাবিত করে। এই ডিভিশন সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পালন করবে। মুক্তবাজার ব্যবস্থার আওতায় বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার প্রত্যক্ষ সক্ষমতা অর্জনেরও পদক্ষেপ নেবে।
কালের কণ্ঠ : ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে এই মুহূর্তে করণীয় কী?
গোলাম রহমান : প্রথমত, পণ্য সরবরাহ যাতে সন্তোষজনক থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্যমূল্য যাতে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এবং সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সেদিকে সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে। সরবরাহ চেইন যাতে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় এবং কারসাজির মাধ্যমে কেউ যেন বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং অপচেষ্টায় নিয়োজিতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থ ও মুদ্রানীতি ও ব্যবস্থাপনা ভোক্তাবান্ধব এবং মুদ্রাস্ফীতি রোধের উপযোগী করে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : এর বাইরে বাজার ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আপনি কি কিছু বলবেন?
গোলাম রহমান : বাজার সার্বিক অর্থনীতির একটি অংশ। বাজারে পণ্যমূল্য সব সময় অপরিবর্তিত থাকবে—এমনটা আশা করা সংগত নয়। দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনীতিতে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে মৃদু মুদ্রাস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত। সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধির হার পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার অপেক্ষা দৃশ্যমান অধিক হলে ভোক্তার কল্যাণ বাড়ে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না থাকলে, সমাজে আয়বৈষম্য লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেলে এবং পণ্যমূল্য অনিয়ন্ত্রিত থাকলে সার্বিক কল্যাণ হ্রাস পায়। উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত এবং এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিষ্পেষিত হচ্ছে, যা সরকারের বড় বড় অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার বাজারে স্বস্তি আনতে এবং মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগার বৃদ্ধিতে আরো যত্নবান ও উদ্যোগী হবে, সেই প্রত্যাশা করছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ
গোলাম রহমান : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।