অধ্যাপক এম শামসুল আলম। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের ডিন। স্বেচ্ছাব্রতী সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে পালন করছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব। জ্বালানি খাতে সরকারের নানা তৎপরতা নিয়ে গণপক্ষের হয়ে দীর্ঘদিন ধরে সওয়াল করছেন তিনি। তার প্রত্যক্ষ উদ্যোগের ফলে আবাসিক ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়েনি গত দু’বছর ধরে। এখন আবার সেই আয়োজনই শুরু হয়েছে। সব শ্রেণির গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে শুনানি ডেকেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ‘সাপ্তাহিক’ ম্যাগাজিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আনিস রায়হানকে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আলম বলেছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এ শুনানি অবৈধ। কেন এটা অবৈধ, তা ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি কথা বলেছেন সরকারের জ্বালানি উন্নয়ন দর্শনের ভ্রান্তি নিয়ে। এর বিপরীতে গৃহীত নানা পদক্ষেপের বিষয়েও বলেছেন বিস্তারিত।
আনিস রায়হান : আবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস আগে, ১৬ অক্টোবর ২০১৮, এ বিষয়ে আদেশ দিয়েছিল বিইআরসি। এখন আবার মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে শুনানির আয়োজনকে কীভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক এম শামসুল আলম : মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর বিইআরসি সর্বশেষ যে আদেশ দিয়েছে, তাতে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু ওই আদেশে গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি করে ৭ টাকা ১৭ পয়সা থেকে ৮ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়। এর মধ্যে কোম্পানিগুলোর সঞ্চালন চার্জ ১৫ পয়সা থেকে বৃদ্ধি করে ৪২ পয়সা করা হয়েছে। আর কোম্পানিভেদে অভিন্ন বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা করা হয়। আগে তিতাসের বিতরণ চার্জ ছিল ২২ পয়সা। সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ বৃদ্ধির ফলে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে রাজস্ব ঘাটতি হয় ১ টাকা ৪৬ পয়সা। মোট গ্যাসের হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এ টাকার ভারটা ভোক্তার কাঁধে না দেয়ার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি। প্রতি ঘনমিটারে সরকারি অনুদান ১ টাকা, যা মোট হিসাবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা অর্থাৎ মোট দেড় হাজার কোটি টাকা সমন্বয়ের নির্দেশনা দেয় বিইআরসি।
আমরা দেখতে পাই, সর্বশেষ আদেশে সঞ্চালন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে যে পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি করা হয় সেটা অতিরিক্ত ছিল। গণশুনানিতে প্রমাণ হয়, সঞ্চালন চার্জ ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৫ পয়সা করা হলেই ঘাটতি মিটে যেত। কিন্তু তা ৪২ পয়সা করার ফলে জিটিসিএল-এর চলতি অর্থবছরে রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকবে ৫৪৪ কোটি টাকারও বেশি। আর একটি বিতরণ কোম্পানির হাতে তখনই উদ্বৃত্ত ছিল ৪৭০ কোটি টাকার বেশি। যা প্রমাণ করে ব্যয়ের তুলনায় বাড়তি রাজস্ব আয়ের ক্ষমতা তাদের আগেই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বশেষ আদেশে বিতরণ চার্জ গড়ে ২৫ পয়সা করায় এ বছর তিতাসের রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকবে ৬৮১ কোটি টাকার বেশি।
আমাদের হিসাব বলে, ন্যায়সঙ্গতভাবে মূল্যবৃদ্ধি করা হলে এখন যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে, তা বড়জোর তিন হাজার কোটি টাকা হতো। অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আদায়ের ক্ষমতা কোম্পানিগুলোকে দেয়া হয়েছে। বিইআরসির ওই আদেশ ন্যায়সঙ্গত হয়নি বলে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। যে কারণে সংস্থাটির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে আমরা হাইকোর্টে রীট মামলা দায়ের করেছি। মাননীয় হাইকোর্টও আমাদের মামলাটি আমলে নিয়েছেন।
আনিস রায়হান : আদালতের কাছে আপনাদের আর্জিটা কী, বিস্তারিত বলবেন?
এম শামসুল আলম : এখানে বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো বিইআরসি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, এটা বন্ধ করা। যে নিয়ম বা পদ্ধতি রয়েছে, তার ব্যত্যয় ঘটানোর এখতিয়ার বিইআরসির নেই। তাকে অবশ্যই আইনে নির্দেশিত পদ্ধতি মেনে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে তার সিদ্ধান্ত এখতিয়ার বহির্ভূত হিসেবে বিবেচিত হবে। সর্বশেষ আদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিইআরসি এখতিয়ার বহির্ভূত উপায়ে চার্জ বৃদ্ধি করেছে। আমরা এসব চার্জ বৃদ্ধির আদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছি। কারণ শেষ অবধি সমস্ত চার্জ ভোক্তাকেই পরিশোধ করতে হয়।
গ্যাস উৎপাদন কোম্পানিগুলোর মূল্যহার কমানো বা বাড়ানোটা মোটেও বিইআরসির ব্যাপার নয়। কিন্তু এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে তারা সেখানেও ঢুকে পড়েছে। সিলেট গ্যাসফিল্ড, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড ও বাপেক্সের জন্য গ্যাস উৎপাদন দাম সরকার কর্তৃক বিধিবদ্ধভাবে নির্ধারিত। বিদেশি তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানির (আইওসি) ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এসব কোম্পানির গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয় সরকারের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে। এটা পরিবর্তনের এখতিয়ার বিইআরসির নেই। আইওসির গ্যাসের দাম ২ টাকা ৫১ পয়সার বিপরীতে বাপেক্সের গ্যাসের দাম ৮৮ পয়সা প্রতি ঘনমিটার নির্ধারিত ছিল। আইওসির গ্যাসের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাপেক্সের গ্যাসের দাম ৩ টাকা ১ পয়সা করে দিয়েছে বিইআরসি। প্রথমত, এখানে ১ পয়সাও মূল্যবৃদ্ধির বা কমানোর আইনি কর্তৃত্ব বিইআরসির নেই। দ্বিতীয়ত, বিদেশি কোম্পানির গ্যাসের মূল্যের চেয়েও দেশি প্রতিষ্ঠানের গ্যাসের মূল্য কেন অযৌক্তিকভাবে এত বেশি নির্ধারণ করা হলো, এর কোনো ব্যাখ্যাও তারা দিল না।
এখন মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘাটতি হিসেবে যে অর্থের হিসাব দেয়া হচ্ছে, সেগুলো এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। বিইআরসির এসব পদক্ষেপে ভোক্তাস্বার্থ লঙ্ঘিত হয়েছে। আমরা এসব অনিয়মের বিচার চেয়েছি। এ ছাড়া আমদানিকৃত এলএনজি উচ্চমূল্যের জ্বালানি হওয়ায় যে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে, তা ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে আইওসির গ্যাস থেকে শুল্ক-ভ্যাট বাবদ প্রাপ্ত পুঞ্জীভূত অর্থ থেকে এই ঘাটতি সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছি। মামলাটি মাননীয় হাইকোর্টে বিচারাধীন।
আনিস রায়হান : কোম্পানিগুলো কেন ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও আবারও মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পেশ করছে?
এম শামসুল আলম : নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব তখনই করা যায়, যখন উৎপাদন, সরবরাহ ও বিতরণে রাজস্ব ঘাটতি সৃষ্টি হয়। যে তথ্যাদি আমরা পেশ করলাম তাতে এটা পরিষ্কার যে, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো কোনো রাজস্ব ঘাটতিতে নেই। কিন্তু মাত্র চার মাসের মাথায় বিইআরসি আবারও মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাব এবং ভোক্তা পর্যায়ে সব শ্রেণির গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব আনা হয়েছে। কিন্তু চার মাস আগে যেখানে মূল্যহার সমন্বয় করে দেয়া হলো, এবং কোম্পানিগুলো কোনো ঘাটতিতে নেই, সেক্ষেত্রে বিইআরসি কর্তৃক মূল্যবৃদ্ধির আবেদন গ্রহণের কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না।
যদি বিইআরসির কর্মকাণ্ডে এটা প্রতিফলিত হয় যে, সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তখন দাম বাড়ায়নি, যেমনটা নানা মাধ্যমে বলা হচ্ছে, তাহলে তো সেটা হবে প্রতারণা। বিইআরসি কেন প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, সরকার মানুষের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে? সেক্ষেত্রে এটাও প্রমাণ হয় যে, বিইআরসি তখন মূল্যহার সমন্বয়ে ভুল আদেশ দিয়েছিল। এটা তাদের পক্ষপাতিত্বেরও উদাহরণ হয়ে থাকবে।
কোনো রাজস্ব ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলো ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৪ টাকা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। এটা একেবারেই স্বেচ্ছাচারপ্রসূত, কোনো নিয়ম বিধি বিবেচনা না করেই তারা এ কাজটি করেছে। যে নিয়মের আওতায় প্রস্তাব আনার কথা, সে নিয়মের আওতায় তারা আসছে না। এটাই আমাদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য, বিইআরসিরও সেটাই দেখার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম, অযৌক্তিক প্রস্তাব হওয়া সত্ত্বেও তা আমলে নিয়ে বিইআরসি এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে অবৈধ গণশুনানির আয়োজন করেছে। এ শুনানি বাতিলের জন্য আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি।
আনিস রায়হান : বিইআরসি তো এ খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তারা যদি নিয়ম অনুযায়ী না চলে সেক্ষেত্রে করণীয় কী?
এম শামসুল আলম : বিইআরসির আদেশগুলো ভোক্তার পক্ষ থেকে আমরা চ্যালেঞ্জ করছি, এটাই প্রথম করণীয়। এর মাধ্যমে প্রমাণ হচ্ছে যে, সংস্থাটি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। আদালত থেকে এর মধ্য দিয়ে কোনো প্রতিকার বেরিয়ে আসতে পারে। আবার এই যে তারা আদালতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছেন, এটাই অদৃশ্য পথে অনেক পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারে বা দিচ্ছে।
এ ছাড়া আমরা সরকারের কাছে সংলাপ চেয়েছি। সংলাপের বিষয়ে সরকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে আলোচনার এজেন্ডাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, জ্বালানি খাতের বিভিন্ন জায়গায় আমরা সংস্কার চেয়েছি। বিইআরসির ক্ষেত্রেও সংস্কার চাওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে আমরা একটি অবস্থান পত্র অর্থাৎ আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্যও প্রস্তুত করেছি। সেটা এখনও সরকারকে দেয়া হয়নি, সময়মতো দেয়া হবে। এভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবনা আমরা দিচ্ছি। এর মাধ্যমে সরকারকে আমরা আলোচনার টেবিলে আনতে চাই। আমাদের লক্ষ্য হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভ্রান্তিগুলো দূর করা এবং এ খাতে গণমুখী উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা।
আনিস রায়হান : উচ্চমূল্যের এলএনজি আসছে। সরকার তো এ ব্যয়টা সমন্বয় করতে চাইবে…
এম শামসুল আলম : এ যাবৎ গ্যাস খাত লাভজনক ছিল। প্রতিবারই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে নানা ইস্যুর ভিত্তিতে। কখনো সম্পদ মূল্য, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, কখনো তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয়- এসব কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, ঘাটতি পূরণের জন্য নয়। গ্যাসখাত অত্যন্ত লাভে ছিল, সরকার গ্যাস বিক্রির অর্থ থেকে ৫৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় করেছে। এখন সরকার জ্বালানি সংকট মেটাতে এলএনজি আমদানি করছে। ফলে গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় বেড়ে এ খাতে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় গ্যাস খাত থেকে সরকার সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এবং প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে ১ টাকা হারে ভর্তুকি দিচ্ছে, যা আগেই উল্লেখ করেছি।
গ্যাস খাত ঘাটতিতে পড়ায় বিইআরসি তা সমন্বয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। মাত্র চার মাস আগে তা কার্যকর হলো। এখন যদি সরকার মনে করে এটা ঠিকঠাক চলছে না, তাহলে তো তাদের নতুন ঘাটতি প্রমাণ করতে হবে। আমরা সেরকম কিছু দেখছি না। এলএনজির নতুন চালান যোগ না হওয়া পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। উল্টো মূল্য যেহেতু নিয়ম বহির্ভূতভাবে বেশি বাড়ানো হয়েছে, তাই তা কমার সুযোগ রয়েছে।
আর সরকার তার নীতি পরিবর্তন করতে পারে। সরকার বলতে পারে বা দাবি করতে পারে যে, আমি আর অনুদান বা ভর্তুকি দেব না। তাহলে কোনো বিতরণ বা সঞ্চালন কোম্পানি নয়, মূল্যবৃদ্ধির আবেদন করতে হবে স্বয়ং সরকারকে। তখন বিইআরসি তা আমলে নিয়ে শুনানির আয়োজন করতে পারে। কিন্তু আমরা মনে করি, জ্বালানি এমন একটি খাত যে তা ভর্তুকির যৌক্তিক দাবিদার। তা সত্ত্বেও আমরা ভর্তুকি দাবি করিনি। আমরা বলেছি, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঘাটতি দেখানো হলেও প্রকৃত ঘাটতি তিন হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা আছে, এ বছর সেখানে আরও তিন হাজার কোটি টাকা যুক্ত হবে। আমরা প্রস্তাব রেখেছি যে, সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নয়, জনগণের ওপরও বাড়তি মূল্য চাপানো নয় বরং এই টাকাটা জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে দেয়া হোক। এরপর নতুন করে এলএনজি এলে তখন ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে।
আনিস রায়হান : জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেয়ার পক্ষে আপনাদের যুক্তি কী?
এম শামসুল আলম : জ্বালানির বিদ্যমান দাম যদি হঠাৎ করে বেশি রকমের বেড়ে যায়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতি তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। জ্বালানির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় পরিবহনের ব্যয়। বাড়ে সার ও বিদ্যুতের দাম। এভাবে সমগ্র উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং জীবন যাপনের ব্যয় বেড়ে যায়। এর ফলে রপ্তানিমুখী পণ্যগুলো বিদেশের বাজারে বিরাট চাপের মুখে পড়ে, কেউ কেউ বাজার হারায়। দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি হয়।
সাধারণ মানুষের নিয়মিত আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বর্ধিত এই ব্যয় সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে। তখন ব্যয় সাশ্রয় করেও অনেক ক্ষেত্রে তারা সংকট মোকাবিলা করতে পারে না। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিটা এরকম অনেক বিষয়ের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর যাতে বিরূপ প্রভাব না পড়ে তাই সরকারকে জ্বালানি খাতের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হয়। এজন্যই এ খাতে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ভর্তুকি দিতে হয়।
আনিস রায়হান : জ্বালানি খাত উন্নয়নে ভুল-ভ্রান্তির কথা বললেন। এটা পরিষ্কার করবেন কি, সরকার জ্বালানি খাত উন্নয়নে কোন দর্শন প্রয়োগ করছে?
এম শামসুল আলম : সরকারের বিগত দুই মেয়াদ বিবেচনায় নিলে এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা সম্ভব। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তারা পার্টিসিপেটরি পার্সপেক্টিভ প্ল্যান তৈরি করে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিল এটি বাস্তবায়নের মেয়াদ। এই পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়ন প্রাধান্য পেয়েছিল। বলা হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ থেকে গ্যাস খাতকে অবমুক্ত করা হবে। একটি রোডম্যাপে এও দেখানো হয় যে, শুরুতে বিদ্যুতের মূল্য বাড়লেও ২০১৪ সাল থেকে তা আবার কমে আসবে। ওই পরিকল্পনায় আরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্যাস উৎপাদনে দেশি ও বিদেশি কোম্পানির মধ্যে ভারসাম্য আনার বিষয়ে। এর প্রেক্ষিতেই গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী এ খাতে ভর্তুকির প্রয়োজনের কথাও তাতে বলা হয়।
এই পরিকল্পনা তখন ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হলো না। কিন্তু এরপর সরকার যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এলো, ওই পরিকল্পনা থেকে তারা পুরোপুরি সরে গেল। জ্বালানি খাত থেকে এতদিন সরকার ভ্যাট-শুল্ক আদায় করত। কিন্তু এই পর্যায়ে দেখা গেল, সরকার তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভবান করতে চাইছে। ব্যক্তি খাত যেমন মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, মুনাফাই থাকে তার ধ্যান-জ্ঞান, সরকারের কার্যক্রমেও একই নীতি প্রতিফলিত হলো। সরকারি কোম্পানিগুলো আর তার পণ্যের দাম নির্ধারণে ব্যয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। তারা ‘কস্ট প্লাস’ অর্থাৎ ব্যয় তো বটেই, তার ওপর বাড়তি লাভ ধরে দাম নির্ধারণ করতে লাগল। এভাবে ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একই কাতারে এসে দাঁড়াল। এটা নির্দেশ করে যে, সরকারের চরিত্র ব্যবসায়ী চরিত্র হয়ে গেল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে যে দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে, সরকারের এই নীতি তার বিপরীত। সংবিধানের ১৩তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পত্তিতে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র ওই সম্পত্তির মালিক। আরও জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালির মালিক হবে জনগণ। এর অর্থ দাঁড়ায় সরকার কেবল প্রতিনিধি মাত্র, আসল মালিক জনগণ। সংবিধান অনুযায়ী তাই আমরা প্রশ্ন রাখতে পারি, প্রতিনিধি কীভাবে মালিকের কাছ থেকে মুনাফা আদায় করে?
সরকার জনগণের কাছ থেকে ভ্যাট-কর পাবে। কিন্তু জনগণের কাছ থেকে সরকার মুনাফা দাবি করতে পারে না। উপরন্তু কর আদায়ের ক্ষেত্রেও সরকার এমন কোনো পথ নিতে পারে না, যাতে প্রান্তিক মানুষেরা চাপে পড়ে। সরকারের দায়িত্ব থাকে প্রান্তিক জনগণকে যেকোন বিরূপ অভিঘাত থেকে সুরক্ষা দেয়া। কিন্তু ২০১৪ সালের সরকারের কর্মকাণ্ডে আমরা দেখলাম সংবিধানের এ চেতনা ক্রমশ উবে যাচ্ছে। এ সময় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের ভ্যাট-কর বাড়িয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ করে ফেলে। এটা সরকারের মুনাফাবান্ধব দর্শনেরই প্রতিফলন।
গ্যাস খাতে কোম্পানিগুলোকে এর পর থেকে যেকোন পরিস্থিতিতে লাভে রাখা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে তেলের দাম কমলেও সরকার তেলের দাম কমায়নি। এভাবে সরকার কোম্পানিগুলো থেকে ডিভিডেন্ড, বাড়তি কর্পোরেট ট্যাক্স, শুল্ক ও সরাসরি মুনাফা আদায় করেছে। ব্যক্তি খাতের চেয়েও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুনাফা আহরণের নীতি আরও বেশি লোভনীয় মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়েছে।
আনিস রায়হান : সরকারের এমন নীতির বিপরীতে জ্বালানি খাত উন্নয়নে আপনার প্রস্তাবনা কী?
এম শামসুল আলম : আমরা মনে করি, সরকার জনগণের সেবা করবে। কিন্তু সরকার বাণিজ্য করছে। সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকার তার মুনাফা নিশ্চিত করছে। এই মুনাফা নেয়াটা আর কিছু নয়, জনগণকে শোষণ করে সরকারের ঘরে তার অর্থ নেয়া হচ্ছে। সেখান থেকে এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে, সেটা আরেক প্রশ্ন। আমি সেখানে যেতে চাচ্ছি না।
আমাদের বক্তব্য হলো, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চলবে খরচ আদায়ের ভিত্তিতে, লাভের ভিত্তিতে নয়। পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণে শুধু তার খরচটাই বিবেচিত হবে। নো লস, নো প্রফিট নীতি কার্যকর করতে হবে। এখানে সরকারের ক্ষতিও স্বীকার করতে হবে না, আবার মুনাফা করারও কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে সরকারি পণ্য বা সেবার দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সংশ্লিষ্ট খাতে যেসব ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি থাকবে, তারা তখন বাজারে টিকে থাকার স্বার্থে সরকারি পণ্য বা সেবার কাছাকাছি দামে ব্যবসা করবে। এভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের একচেটিয়া হয়ে ওঠার ব্যাপারটি রোধ করা যাবে।
আনিস রায়হান : ১১ মার্চ আসন্ন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির শুনানিকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছেন, এই শুনানিতে কি অংশ নেবেন?
এম শামসুল আলম : শুনানিতে অবশ্যই অংশ নেব। কেউ যদি কিছু শোনাতে চায়, কেন শুনব না? শুনানিতে গিয়েও বলব যে, বিইআরসি এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে এটি আয়োজন করেছে এবং কোম্পানিগুলো যে অযৌক্তিক প্রস্তাবনা হাজির করছে, সেটা গণশুনানির মাধ্যমে প্রমাণ করা হবে।
[সূত্র : সাপ্তাহিক, বর্ষ ১১, সংখ্যা ৩৭, ২০১৯, মার্চ, প্রথম সপ্তাহ]