অধ্যাপক কবিরুল বাশার। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। কবিরুল বাশার কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র মশা গবেষক। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা নিয়ন্ত্রণে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। সম্প্রতি ভোক্তাকণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বর্তমানে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবং সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতে কেমন হবে, ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে কি কি করণীয়সহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক কবিরুল বাশার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রিয়াল।
ভোক্তাকণ্ঠ: বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের রেকর্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার সর্বোচ্চ হলো। এছাড়া মৃত্যুর যে রেকর্ড সেটাও সর্বোচ্চ। যেটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এবারই প্রথম বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এমনকি উপজেলা শহরেও ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। আমরা জানি ডেঙ্গুর প্রধান বাহক হচ্ছে এডিস ইজিপ্টাই মশা। এডিস এলবোপিকটাস মশাটাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ছড়ায়। তবে এডিস ইজিপ্টাই মশাকে আমরা একটা সময় নগরের মশা বলতাম। যা শহরের মশা হিসেবে নেই। গ্রামাঞ্চলে এখন নগরায়ণ হয়েছে। এবং গ্রামেও ডেঙ্গুর যে প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টাই, সে মশাটি চলে গিয়েছে। যে কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার বাংলাদেশে খুব ভয়াবহ হয়েছে। যা আমাদের জন্য অনেক শঙ্কার। বা এই বিষয়টি নিয়ে আমরা আতঙ্কিত।
ভোক্তাকণ্ঠ: সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: এ বছরই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে ডেঙ্গুটি বিস্তৃত হয়েছে। সে জন্য আমাদের আগামী দিনগুলোতে ডেঙ্গু বিস্তৃতি হবে সারাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা এবং গ্রামগুলোতে। সে জন্য সামনের দিনের পরিস্থিতি আমাদের জন্য আরও বেশি আশঙ্কাজনক। সামনের দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপশহরকে মাথায় রেখে আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সমন্বিত মশক নিধন ব্যবস্থাপনা, গ্রামভিত্তিক বা গ্রামকে চিন্তা করে প্রণয়ন করতে হবে। এবং সেটির বাস্তবায়ন করতে পারলেই ডেঙ্গুকে মোকাবেলা করতে পারবো।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অন্য বছরের তুলনায় বেশি। এবার পরিস্থিতি ভয়াবহ কেন?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে মূল কারণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জলবায়ূ পরিবর্তন। এর ফলে সারা পৃথিবীতেই এই এডিস, এডিস মশা বাহিত রোগ, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, জিকা এগুলো বেড়ে গেছে। তার একটি প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আবার বাংলাদেশে আমরা মশা নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছি। নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। মশা নিয়ন্ত্রণে হয়তো ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কিছু কিছু কাজ করেছে কিন্তু ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখিনি বা তেমন কোনো জনবল, লজিস্টিকস, কিটনাশক কিছুই তাদের নেই। সে জন্য ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারের উদাসীনতা দেখছেন কি না?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াতে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্টের যে চারটি কম্পোনেন্ট আছে, সেই চারটি কম্পোনেন্টের মধ্যে একটি হচ্ছে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা। বা যেসব জায়গাতে এডিস মশাটি হয় সেসব জায়গাকে পরিবর্তন করে দেওয়া। যেমন ছোট বড় পাত্র, সেই পাত্রটি যদি আমরা উল্টে রাখি, তাহলে সহজেই এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, অন্য জীবকে দিয়ে মশাকে নিয়ন্ত্রণ, তৃতীয়টি হচ্ছে কিটনাশক, চতুর্থটি হলো জনগণকে সম্পৃক্ত করা বা জনগণের সম্পৃক্ততা। এই চারটি কম্পোনেন্টকে একত্রিত করে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ করতে পারলে সফলতা আসবে। এখন এই চারটি কম্পোনেন্টের মধ্যে একটি কম্পোনেন্ট হচ্ছে সরকারের দায়। সেটি হচ্ছে কিটনাশক দ্বারা নিয়ন্ত্রণ। আর বাকিগুলো হচ্ছে সোর্স রিডাকশন। সেটি জনগণকে নিজ দায়িত্ব থেকে করতে হবে। জনগণের যে সম্পৃক্ততা এটাও জনগণকেই হতে হবে। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও কিন্তু দায় নিতে হবে। কারণ এডিস মশা আমাদের বাড়ি, বাড়ির আঙ্গিনায় পড়ে থাকা বিভিন্ন ছোট বড় পাত্রে হয়। সেই পাত্র অপসারণ করা বাড়ির মালিক হিসেবে সেটা আমার দায়িত্ব। আর সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থাপনা, বেসরকারি স্থাপনা, সরকারি স্থাপনা- সেসব জায়গাতে মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমকে জোড়দার করা। সে জন্য সরকারি এবং বেসরকারি এই দুটির সমন্বয়ে যখন উদ্যোগ গ্রহণ করবে তখনই মশা নিয়ন্ত্রণ হবে। অন্যথায় এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। শুধুমাত্র সরকারের দায়ও না, শুধুমাত্র জনগণের দায়ও না। দুই পক্ষকে একসঙ্গে এসে কাজটি করতে হবে।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গুর ভিন্ন ভিন্ন ধরণ সম্পর্কে যদি বলতেন। এসব ধরণ কীভাবে আলাদা ভাবে বোঝা যায়?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: ডেঙ্গু চারটি সেলোটাইপে ছড়ায়। ডেঙ্গু এক, দুই, তিন এবং চার। এই চারটি সেলোটাইপের মধ্যে বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সেলোটাইপ আমাদের জনগণের মধ্যে সার্কুলেট হয়েছে। যখন একটি সেলোটাইপ দিয়ে একবার বেশি আক্রান্ত হয়, হয়তো ওই বছর ওই সেলোটাইপ দিয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু এ বছর আমরা দেখছি দুটি সেলোটাইপ দিয়ে মিক্সট ইনফেকশনও হয়েছে। ডেঙ্গু দুই, ডেঙ্গু তিন মানুষের দেহে পাওয়া গেছে। একেকটা সময় বাংলাদেশে একেক সেলোটাইপ বেশি ছড়ায়। কোনো সেলোটাইপ কম কোনো সেলোটাইপ বেশি হয়। তবে এ নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ গবেষণা কিন্তু আমাদের দেশে নেই। কোন সেলোটাইপটি বেশি সার্কুলেট হচ্ছে বা কোন সেলোটাইপটি কম। সেলোটাইপ যাই হোক না কেন ডেঙ্গুর চিকিৎসা একই রকম। সে জন্য যখনই ডেঙ্গু পজিটিভ হয়, সঙ্গে সঙ্গে সেটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে আপনার ডেঙ্গু হয়েছে কি না? যদি ডেঙ্গু হয় সেটি যে সেলোটাইপ দিয়েই হোক না কেন আপনি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে যদি থাকেন তাহলে মৃত্যু একেবারেই শূন্য। সে জন্য একদম অবহেলা না করে আপনার ডেঙ্গু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন, যে আপনার ডেঙ্গু হয়েছে কি না? যদি হয়ে থাকে তবে আপনি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে থাকবেন।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এত ভয়াবহ কেন?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: ডেঙ্গুর কয়েকটি টাইপ রয়েছে। একটিকে বলা হয় ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গি। যেটি খুব স্বাভাবিক ভাবে সামান্য সিমটম শো করে। রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায় না। সেটিকে বলা হয় ক্লাসিক্যাল সিমটম। আর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, আরেকটি আছে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারটা তখনই বলা হয়, যখন কোনো একজন রোগীর দেহের কোনো একটি জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। হেমোরেজিক মিনস রক্তক্ষরণ। সেটি তার দাত দিয়ে রক্ত বের হতে পারে, তার বমির সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে, চোখের কর্ণিয়া বা চোখের ভেতর থেকে রক্ত বের হতে পারে, যেকোনো জায়গা থেকে যখন একজন রোগীর রক্তক্ষরণ হয় তখন সেটাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারটা যখন হয় তখন তার দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্ল্যাটিলেটের পরিমাণ ব্যাপক আকারে কমে যায়। পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যায়। সে জন্য ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার যখন হবে বা আপনার শরীরের কোথাও থেকে যদি রক্তক্ষরণ হয় আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের চিকিৎসা করা খুব কঠিন।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গুর সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ কোনটি?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: ডেঙ্গুর মারাত্মক ধরনের মধ্যে হেমোরেজিক ফিভার অথবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এছাড়া ডেঙ্গু হিমোরোজিক বিষয়টি তো আছেই। রক্তক্ষরণের বিষয়টি। আর ডেঙ্গু শক সিনড্রোম যখন হয়ে যায় তখন তার দেহে প্লাজমা লিকেজ হয়ে যায়। তার হঠাৎ করেই ব্লাড প্রেসার ফল করে। তখন তার হেমোরেজিক ডেঙ্গু ফিভারের সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে। যেটাই হোক আপনি বা আপনার পরিবারের সকলকেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নিবিড় পরিচর্যা বা চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হবে।
ভোক্তাকণ্ঠ: এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এখনও ঠিক কোথায় ঘাটতি রয়েছে? অগ্রগতিই বা কতটুকু হয়েছে?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: আমাদের দেশে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঘাটতির মূল জায়গাটি হলো, আমরা যে বিষয়টি দেখি সেটি হচ্ছে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে। আসলে মশা নিয়ন্ত্রণ যদি আমরা কিউলিস মশার কথা বলি সেটি সম্পূর্ণ আলাদা। এডিস মশা হয় বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় পানির পাত্রে। কিউলিস মশা হয় ছোট-বড় ড্রেন বা নর্দমার পঁচা পানিতে। সে জন্য এই দুটি মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণই আলাদা। আমরা যদি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কিউলিস মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে না পারি তাহলে আমাদের এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ কোনো দিনই হবে না। যেসব পাত্রে/জায়গায় এডিস মশা হয় সেসব পাত্র অপসারণ বা জায়গাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
জনসাধারণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সেই কাজটি করতে হবে। এবং এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মানুষের বাড়ি বাড়ি ধরে জোরদার করতে হবে। একটি এলাকাতে প্রত্যেকটি বাড়িতে বাড়িতে ভিজিট করে ছোট-বড় যে পাত্রগুলো রয়েছে সেগুলোকে অপসারণ করে দেওয়াটা হবে মূল কাজ। কীটনাশক নির্ভর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা আসলে কখনোই বিজ্ঞানভিত্তিক হবে না। সে জন্য আমরা সব সময় বলে আসছি যে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ সারা বছরব্যাপী করতে হবে। যখন এডিস মশা খুব বেড়ে যায় বা ডেঙ্গু শুরু হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে না করে আমরা যদি এই কার্যক্রমটি সারা বছর সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ করাতে পারি তখনই এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ হবে অন্যথায় ডেঙ্গু নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্পোরেশন যে কার্যক্রম চালাচ্ছে তা কতটুকু কার্যকর বলে মনে করছেন?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে কার্যক্রমগুলো করছে তা আংশিক। তার মধ্যে আমি যে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা বলি তার যে চারটি কম্পোনেন্ট আছে সেগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ ঘটানো হয় না। হয়তো কেমিক্যাল দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তারা খুব জোরদার ভূমিকা রাখে। জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করে। তাদের যে কার্যক্রমগুলো আছে সেই কার্যক্রমগুলো সম্পূর্ণ রূপে বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের ঘাটতি আছে। সে ঘাটতি পূরণ করে আমাদেরকে ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্টের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ বছরব্যাপী করতে হবে।
তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনগুলো তো অল্পমাত্রায় বা যতটুকু পারছে চেষ্টা করছে কাজ করার। বাংলাদেশে এবার ডেঙ্গু প্রত্যেকটি জেলাতে ছড়িয়েছে। এমন অনেক জেলা রয়েছে যেখানে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমই নেই। সেখানে কোনো জনবলই নেই, সেখানে কোনো কীটনাশক নেই, সেখানে কোন ফগিং মেশিন নেই। সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশের জন্য একটি সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা গ্রামকে টার্গেট করে তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে সেখানে জনবল নিয়োগ করতে হবে। লজিস্টিকস, মেশিনারিজ, কীটনাশক প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ ভবিষ্যত দিনগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
ভোক্তাকণ্ঠ: দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শকরা নানা সময়ে সরকারকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় পরামর্শ ও সতর্ক করেছে। তাদের সেই পরামর্শ ও সতর্কতা আমলে নেওয়া হচ্ছে না কেন?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: আমরা বছরে শুরু থেকেই বলে এসেছি যে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকাতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিস্তৃত হবে। তাই আগে থেকেই আমাদেরকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এই প্রস্তুতিগুলো যতদিন পর্যন্ত আমরা গ্রহণ করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমাদেরকে সমস্যা ফেস করতে হবে। সে জন্য আমি সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে বিশেষ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদেরকে বলব যে ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্টে সম্পূর্ণ বাংলাদেশকে টার্গেট করে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এবং এখনই সেটি তৈরি করে রাখতে হবে। কারণ সামনের দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। আমাদের এই পরামর্শগুলো যদি আমলে না নেয়া হয় তাহলে সামনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গুর কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কত?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: ডেঙ্গুর যে আর্থিক ক্ষতি সেটি পরিমাপ করা বেশ কঠিন। আপনারা জানেন যে বাংলাদেশে মশা নিয়ন্ত্রণে কয়েল, ভেপোরাইজার, ম্যাট, ব্যাট এগুলোর বাজারই প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার উপরে। এগুলো তো সবই মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে জনগণ ব্যবহার করছে। তারপর সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের ব্যয়ও হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। এছাড়া হাসপাতালগুলোর ব্যয় এবং হাসপাতাল পরিচালনার ব্যয় আছে। রোগীর চিকিৎসা ব্যয় আছে। একজন রোগীর সঙ্গে যারা থাকেন তাদেরও কর্ম ঘন্টা নষ্ট হয়। সেই কর্ম ঘণ্টারও একটা ব্যয় আছে। এই সম্পূর্ণটাই ডেঙ্গুর একটি আর্থিক ক্ষতি। ডেঙ্গুর আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে বিশেষ গবেষণা হওয়া দরকার। সেই আর্থিক ক্ষতি আমার মনে হয় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
ভোক্তাকণ্ঠ: এডিস মশাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে তো এই খরচটা হবে না, তাই না?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: যদি আমরা এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি তাহলে আমাদের এই আর্থিক ক্ষতিগুলো ঠেকানো সম্ভব। সে জন্য আমাদের এই ইনভেস্টমেন্টটা হওয়া উচিৎ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে। ইনভেস্টমেন্টের অর্ধেকও যদি আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করি তাহলেও এই পুরো আর্থিক ক্ষতিটা ঠেকানো সম্ভব।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গু এখন প্রায় সারাদেশে ছড়িয়েছে, এটার কারণ কি?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: একটা সময় নগরে আমরা এডিস ইজিপ্টাই মশাটা পেতাম। এডিস ইজিপ্টাই মশাটাকে নগরের মশা বলা হতো। আর এটি ছিল ডেঙ্গুর প্রধান বাহক। গ্রামে যে মশাটি হতো সেটি এডিস এলবোপিকটাস। কিন্তু আমাদের গ্রামগুলোর চরিত্র বদলেছে। গ্রামগুলোর বিভিন্ন জায়গাতে ছোট-বড় বিল্ডিং হয়েছে। গ্রামগুলো আর গ্রাম নেই সেই গ্রামগুলোতে যখন নগরায়ণ শুরু হয়েছে, এডিস মশাও তার জায়গা করে নিয়েছে। গ্রাম থেকে উপশহরে, উপশহর থেকে গ্রামে এডিস মশা তার অবস্থান এখন পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। এই যে অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাবে এটি এখন সারা বাংলাদেশেই বিস্তৃত হয়েছে।
ভোক্তাকণ্ঠ: ডেঙ্গু নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চলছে, আপনারা বিশেষজ্ঞরাও বিভিন্ন গণমাধ্যমে কথা বলছেন, এর কোনো প্রভাব কি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পড়ছে?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: আমরা একটা কাজ করেছি, আমাদের এই কাজে আমরা যেটা দেখেছি নলেজ অ্যাটিটিউড এন্ড প্র্যাক্টিস অফ দ্য সিটি ডুয়েলারস। নগরবাসীর জ্ঞান আছে, তারা জানে যে এডিস মশা কোথায় হয়, এডিস মশাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। এই জ্ঞানটি কিন্তু নগরবাসীর আছে। নগরবাসী চায় তার বাসাতে এডিস মশা না হোক। তার বাড়ির মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হোক। কিন্তু একটা জিনিসের খুব অভাব আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি, জানে, মানে কিন্তু তারা সেটা প্র্যাকটিসে রূপান্তর করে না। তার বাড়িটা যে সপ্তাহে একদিন ঘুরে দেখতে হবে, তার বাড়ির কোনো জায়গায় পানি জমা আছে কি না, কোনো পরিত্যক্ত পাত্র পড়ে আছে কি না, তার টয়লেটে কোনো পানি জমা আছে কি না, সে দিকে একটু নিয়মিত যে পরীক্ষাটি করবে সেই পরীক্ষার জায়গায় আমরা খুব ঘাটতি লক্ষ্য করি। তাই আমি এখন একটি কথা বলি নগরবাসী সচেতন আছে। কিন্তু নগরবাসী সম্পৃক্ত নয়। নগরবাসীকে সম্পৃক্ত হতে হবে যতদিন পর্যন্ত জনগণ সম্পৃক্ত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমাদের এই বাসা বাড়িতে জন্মানো এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। সে জন্য আমি অনুরোধ করব সকলকে সম্পৃক্ত হওয়ার। যার যার বাড়ি, বাড়ির আঙিনায় একদিন অন্তত ঘুরে দেখা, কোথাও পানি জমা থাকলে সেটিকে ফেলে দেওয়া।
ভোক্তাকণ্ঠ: এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে এই মুহুর্তে কি করা দরকার?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেটি করা দরকার সেটি হচ্ছে আমাদের দেশের সব জেলা, উপজেলা ও গ্রামকে চিন্তা করে একটি জাতীয় মহাপরিকল্পনা তৈরি করা। এই মহাপরিকল্পনার মধ্যে ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্টের সমন্বয় বা এই চারটি কম্পোনেন্টকে সমন্বয় করে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে কিভাবে এটিকে প্রয়োগ করা যায় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ১০ বছর মেয়াদে যদি সেই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে পারি এডিস মশা এবং মশাবাহিত রোগ থেকে আমরা অনেকটাই মুক্ত থাকবো।
ভোক্তাকণ্ঠ: মশার ভোগান্তি থেকে বাঁচার টেকসই সমাধান কী হতে পারে?
অধ্যাপক কবিরুল বাশার: এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান অবশ্যই আছে। সেটি কিন্তু তারা করে দেখিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশ সফল হয়েছে। স্থায়ী সমাধান হচ্ছে ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান বাংলাদেশের জন্য তৈরি করে সেটিকে বাস্তবায়ন করা। যদি সেটিকে সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে নিশ্চই এডিস মশা নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকবে এবং ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকবে।