সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্য বীমা অপরিহার্য: ডা. সাকলায়েন

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট:

ডা. সাকলায়েন রাসেল। একজন ভাসকুলার সার্জন। ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর এন্ড অ্যাসোসিয়েট কনসালটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের সব শ্রেণীর মানুষকে স্বাস্থ্য সেবায় সচেতন করতে সব সময় কাজ করে চলেছেন এই চিকিৎসক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন সচেতনামূলক বার্ত‍া দিচ্ছেন তিনি। একইসঙ্গে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করতেও কাজ করছেন ডা. সাকলায়েন রাসেল।

সম্প্রতি কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ভোক্তাকণ্ঠ’ কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রিয়াল।

ভোক্তা ও পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-

ভোক্তাকণ্ঠ: স্বাস্থ্য সেবা মানেই কী শুধু হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া? আপনার কাছে কি মনে হয়?

ডা. সাকলায়েন রাসেল: অনেকের একটা ধারণা আছে, চিকিৎসা মানেই হাসপাতালে যেতে হবে। চিকিৎসা মানেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। চিকিৎসা মানেই ডাক্তারের চেম্বারে যেতে হবে। তবে আমরা আজকের দিনের প্রেক্ষাপট চিন্তা করি, এখন ঘরে বসেও অনেক চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব। আজকে অনলাইনের যুগে আমরা একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে পারি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের চেম্বার পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন আছে। আমাদের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল এবং ডায়াবেটিস হাসপাতালের যতগুলো শাখা রয়েছে সেগুলোতে ডিজিটাল হেলথ কেয়ার নামে প্রজেক্ট চালু হয়েছে। এটার মূল উদ্দেশ্যই হলো একজন মানুষ ঘরে বসেই তার চিকিৎসা নিতে পারেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা আছেন তারাও যেন সেখান থেকেই বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পান। তাই চিকিৎসা মানেই হাসপাতাল না। বর্তমান যুগে আমরা আরও বিভিন্ন পন্থায় বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা বাসায় বসে নিতে পারি। আপনি কোনো একটি রোগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আমরা বলি যত দ্রুত ওই রোগীকে বাসায় পাঠানো যায়, তাকে হোম এনভায়রনমেন্ট দেওয়া যায়, তত দ্রুত তিনি ভালো হবেন। এখন ট্রেইন্ড হলো, রোগীর হাসপাতালে অবস্থান কমিয়ে বাসায় অবস্থান বাড়ানো। রোগীর বাসায় বসে চিকি‍ৎসা বেশি প্রয়োজন। কারণ এতে রোগী মানসিক এবং শারীরিক ভাবে শান্তিতে থাকে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে সাপোর্ট দেওয়ার মতো ওই রকম সামর্থ্য নেই। সে ক্ষেত্রে তিনি বাসায় থাকতে পারেন। এতে করে তার আর্থিক খরচটাও অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। একটা রোগীর অপারেশন করার পর ভালো হতে তিন থেকে চার মাস লেগে যায়। এতদিন তো হাসপাতালে রাখার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে বাসায় রেখে তিনি কিভাবে ড্রেসিং করতে পারেন আমরা সে ব্যবস্থা করে দেই।

ভোক্তাকণ্ঠ: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ঝুঁকি এবং সচেতন থাকার কৌশল কি?

ডা. সাকলায়েন রাসেল: ডায়াবেটিসকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার। আমরা কখনও কখনও বলি এটা ওপেন কিলারও। দুই ভাবেই এটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ডায়াবেটিস এমন একটা রোগ যতই আপনি কন্ট্রোলে রাখেন না কেন সে চেষ্টা করে আপনার কিছু না কিছু ক্ষতি করার জন্য। তবে যদি কেউ ভালো ভাবে কন্ট্রোলে রাখেন তার কোনো ধরনের ক্ষতি হয় না। ডায়াবেটিসের কাছে কিছু টার্গেট অর্গান আছে অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গকে সে খুব পছন্দ করে। এবং সেই অঙ্গগুলোর ক্ষতি প্রথম দিকেই করার চেষ্টা করে। তার মধ্যে একটি চোখ। আমরা সেটিকে বলি ডায়াবেটিস রেটিক্যালোপ্যাথি। অর্থাৎ চোখের সমস্যা। একই ভাবে ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি। পায়ের হতে পারে, হাতের হতে পারে। ডায়াবেটিস নেকরোপ্যাতি। তার কিডনির সমস্যা হতে পারে। অথাৎ ডায়াবেটিস হার্ট, কিডনি, চোখ এই অংশগুলোকে সবার আগে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। তার মনে হলো যে অঙ্গগুলো আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ডায়াবেটিস সেখানেই ছোবল মারার চেষ্টা করে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি তো ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করছি, কিছু হচ্ছে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তুষের আগুনের মতো সে আপনাকে খেলে ফেলছে। তাই ডায়াবেটিস আক্রান্ত একজন ব্যক্তি যদি কন্ট্রোলে না রাখেন অচিরেই তার অনেক রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। 

তবে সাধারণত দেখি যারা কন্ট্রোলে রাখেন তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তাই এই সমস্ত জটিলতা প্রতিরোধ করতে হলে আপনাকে প্রথমে জানতে হবে ডায়াবেটিসের টার্গেটটা কত থাকা উচিৎ? সুগারটা কত থাকা উচিৎ? পরিবর্তীতে আপনাকে জানতে হবে আপনি কিভাবে সেগুলো মাপবেন এবং কিভাবে সে ওষুধগুলো আপনি গ্রহণ করবেন। এরপর আমরা বলি সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন শারীরিক একটিভিটি বা রেগুলার ব্যায়াম। আপনি যদি প্রতিনিয়ত এক্সারসাইজ করেন দুটো লাভ, এক ওজন কমলো, ডায়াবেটিস কমলো। দুই আপনার ওষুধ যেটা লাগতো তার অর্ধেক লাগবে। ক্ষেত্র বিশেষে লাগবেই না। এটা হচ্ছে ক্ষতি থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায়। আর আমরা দুঃশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করার কথা বলি। যতটুক সম্ভব নিজেদের টেনশনগুলোকে কমিয়ে রাখা এবং অবশ্যই পরিপূর্ণ একটা ঘুম, নামাজ, উপাসনা, যে যে ধর্মের সে অনুযায়ী ব্যবস্থা করবেন দেখবেন আপনার ডায়াবেটিস অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে থাকবে একইসঙ্গে যে ক্ষতি হয় সেটার সম্ভাবনাও কমে যাবে।

ডায়াবেটিসকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার। নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গকে ডায়াবেটিস খুব পছন্দ করে যেমন- হার্ট, কিডনি, চোখ।  এই অঙ্গগুলোকে সবার আগে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। যে অঙ্গগুলো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ডায়াবেটিস সেখানেই ছোবল মারার চেষ্টা করে।

ভোক্তাকণ্ঠ: বিভিন্ন সময় অভিযানে ফার্মেসীতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া যায়। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কতটা ক্ষতিকর?

ডা. সাকলায়েন রাসেল: শুধু মেয়াদোত্তীর্ণ নয়, মেয়াদের একদম শেষ পর্যায়ে আসা যে ওষুধগুলো আছে সেগুলোর ব্যাপারেও আমরা সতর্ক থাকতে বলি। আপনারা জানেন যে একটা ওষুধ তৈরি করার পর থেকে একটা মেয়াদ পর্যন্ত সেটা গ্রহণ করা যায়। সেটা আমরা ওষুধের মেয়াদ বলছি। কোনো কারণে যদি কেউ মেয়াদের বাইরে ওষুধ গ্রহণ করেন, যেমন একজন বিক্রেতা যদি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করেন এটা তো এক ধরনের অপরাধ এবং এটি শাস্তিযোগ্য। তিনি কিন্তু শাস্তির আওতায় চলে আসবেন। অজ্ঞতাবশত তিনিও হয়তো ভুল করতে পারেন। হয়তো তিনি খেয়াল করেননি। সে ক্ষেত্রে ক্রেতারও একটা দায়িত্ব আছে। তিনি যেন একটু দেখে নেন। তিনি যে ওষুধটি নিচ্ছেন সেটাতে পরিপূর্ণ তারিখ দেওয়া আছে কি না। এটা খুবই জরুরী। কেননা এটা গ্রহণ করলে, দুটি দিক ঘটতে পারে- মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে, ওষুধের কার্যকারিতা চলে যাবে। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনি ওষুধ খাচ্ছেন আপনি ভালো আছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। কারণ ওষুধ তো কাজ করছে না। আরেকটা হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণের কারণে ওষুধের বিষক্রিয়া, এটার যে জটিলতা আছে সেগুলো অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে। তাই আমার কাছে মনে হয় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার করার ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। একইসঙ্গে যারা বিক্রেতা আছেন তারা মনে রাখবেন এটা এক ধরনের অপরাধ। এটা কোনো অবস্থাতেই হতে দেওয়া যাবে না।

ভোক্তাকণ্ঠ: সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালু করতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়? এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

ডা. সাকলায়েন রাসেল: স্বাস্থ্য বীমা আমি মনে করি সারা পৃথিবীতেই আছে। এর সুবিধাও আছে অসুবিধাও আছে। সুবিধাগুলোই আমরা সবচেয়ে বেশি মনে করি। আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো- আমি সব সময় অনুভব করি প্রত্যেক মানুষেরই একটা স্বাস্থ বীমা থাকা উচিৎ। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ডাটা অর্থাৎ আমাদের আইডি কার্ডে তাদের পরিচয় বহন করা হচ্ছে সে রকম একটা হেল্থ কার্ডও থাকা উচিৎ। যে কার্ডের মধ্যে তার সম্পর্কে বিস্তারিত দেওয়া থাকবে। যেমন তিনি কি রোগে আক্রান্ত আছেন, কি কি চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রয়োজনে আমাদের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ থাকবে। যে ডাটার মধ্যে আমার তথ্যগুলো সংরক্ষিত থাকবে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার কার্ডটা পাঞ্চ করলেই আমি তার সমস্ত ডাটা পেয়ে যাই। এ রকম সারা বিশ্বেই আছে কিন্তু আমাদের দেশে সেন্ট্রাল ডাটার সিস্টেম নেই। রোগী যদি ডাক্তার দেখানো জন্য এসে পথের মধ্যে সিএনজিতে তার ফাইল হারিয়ে ফেলেন সবই হারিয়ে যায়। এটা হওয়ার কথা না।

সবার জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করা আরও বেশি প্রয়োজন। তাহলে হয়তো সাধারণ মানুষ আরও অনেক বেশি চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাবে।

রেকর্ড কিপিং আমরা করি না। আমরা হসপিটাল ব্য‍াজ করি না। আমরা ব্যক্তিগত ভাবে চিকিৎসকরাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই করি না। সেন্ট্রালি তো হয়ই না। তার মানে এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বীমাটা এমন ভাবে হতে পারে যে যার যতটা সামর্থ আছে তার উপর বেইজ করে সে একটা পার্সেন্টেজ সরকারকে দেবে। তিনি অসুস্থ হলে যেন গ্যারান্টি থাকে তিনি এটার চিকিৎসা পাবেন। এখন যার অনেক বেশি আর্থিক সামর্থ্য আছে তার পার্সেন্টেজ একটু বেশি হবে। যার সামর্থ্য খুবই নিম্নমানের, সে যদি ৫০ টাকাও দেয়, তাকেও স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নিয়ে এসে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকার একটু দায়িত্ব নেয় তাহলে এটা রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার একটা সুবিধা হবে। প্রথম দিকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটা চালু করা যেতে পারে।

ভোক্তাকণ্ঠ: সরকারি ও বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্য সেবার বৈষম্য ও ব্যবধান আপনার কাছে কেমন মনে হয়? যদি ব্যবধান থাকে তবে কেন?

ডা. সাকলায়েন রাসেল: সরকারি ও বেসরকারির মধ্যে একটা বৈষম্য সব সময়ই আছে। যেমন সরকারি হাসপাতালগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রায় ৭৫ ভাগ দখল করে আছে বেসরকারি হাসপাতাল। মাত্র ২৫ ভাগ সরকারি হাসপাতাল সাধারণ মানুষকে সেবা দিচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরকার প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দিয়ে থাকেন। রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়। কিন্তু একটা বেসরকারি হাসপাতালে, যেমন আমাদের ডায়াবেটিস সমিতিতে বিভিন্ন দিক থেকে ভর্তুকি থাকায় রোগীদেরকে একটা লেভেলে নামিয়ে সেবা দিতে পারেন। কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু যখন একটা বেসরকারি হাসপাতালের কথা চিন্তা করি তখন সেই হাসপাতালের স্টাফদের ম্যানেজ করতে হয়, হাসপাতালের খরচ, এর এটাকে একটু লাভজনক অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে হয়। এটা এক প্রকারের ব্যবসা। লাভ ছাড়া তো কেউ করবে না। 

একেক হাসপাতালে একেক ধরনের টেস্টের মূল্য একেক রকম। এটা কিভাবে একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনা যায় সেটা অনেক বেশি প্রয়োজন। 

বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পাচ্ছেন না। ফলে ওইখানে যখন রোগী যাচ্ছেন তখন তাকে চড়া মূল্যেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এবং আরেকটি বিষয় জড়িত, একই টেস্ট বেসরকারি পর্যায়ে একই রেট না। আমার মনে হয় এটার বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া দরকার যে টেস্টগুলোর মূল্যমান কেমন হবে? বেসরকারি অনেক হাসপাতাল আছে তাদের সবার হয়তো বা ক্যাটাগরি করা যেতে পারে। এ ক্যাটাগরির যেসব হাসপাতাল তাদের সবারই একটা টেস্টের মূল্য এক হবে, বি ক্যাটাগরির হাসপাতালগুলোর টেস্টের মূল্য এক হবে। তা না হলে দেখা যাচ্ছে একেক হাসপাতালে টেস্টের মূল্য একেক। এখানে রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। 

এছাড়া রোগীরা ভাবেন আমি সরকারি হাসপাতালে গেলে সস্তায় দেখাতে পারবো। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে গিয়ে তো তিনি সিরিয়াল পাচ্ছেন না। দিনের পর দিন তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তাকে হয়তো বড় বড় টেস্টগুলো বাইরে থেকে করতে হচ্ছে। এই যে অপেক্ষার জন্য তার সময় নষ্ট হলো এতে তারও প্রচুর ব্যয় বেড়ে যায়। এতে দেখা যায়, বেসরকারিতে দ্রুত করলে তার যে টাকাটা খরচ হতো তার থেকে অনেক কম খরচ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সরকারি হাসপাতালে কিন্তু অনাকাঙ্খিত বিলম্বের কারণে বেসরকারির থেকেও খরচ সরকারিতে বেশি হয়ে গেছে। আমার মনে হয় যে, সরকারি এবং বেসরকারিগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে, কিভাবে রোগীদের সেবার মানটাকে বৃদ্ধি করা যায় এ ব্যাপারে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমাদের এগিয়ে যাওয়া তখনই স্বার্থক হবে যখন এই জায়গায় আমরা একটা সমন্বয় নিয়ে আসতে পারবো।

ভোক্তাকণ্ঠ: বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে? কিভাবে সতর্ক থাকা যায়? যদি কোনো পরামর্শ থাকে…

ডা. সাকলায়েন রাসেল: ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এই মুহুর্তে বাড়ছে। আমরা একটা সময় খুব ভয় পেতাম। ডেঙ্গুতে অনেকেই মারা গেছেন। এমনকি অনেক চিকিৎসককে হারিয়েছি শুধুমাত্র ডেঙ্গুর কারণে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপটা যে নেই তা কিন্তু না। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম ভাবতে হবে জ্বর হয়ে গেলে নিজে নিজে একটা ব্যাথানাশক ওষুধ খেয়ে নিলাম, একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিলাম, এটি করাটা ঠিক হবে না।

যেহেতু ডেঙ্গুর সিজন, যদি ডেঙ্গুর উপসর্গ পাওয়া যায়, এখন আলাদা করা যায় না। সাধারণ জ্বরের মতোই প্রকোপ পায়। তারপরও চিকিৎসকের পরামর্শে একটু দ্রুত পরীক্ষগুলো করিয়ে নিন। নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন, যে আমার ডেঙ্গু আছে কি না। ডেঙ্গু যদি হয় ডেঙ্গুর জন্য তার আলাদা চিকিৎসা শুরুতে লাগে না। সাধারণ জ্বরের মতই চিকিৎসা করতে হয়। সেগুলো করতে হবে। তবে একটা বিষয়ে আমি সব সময় বলি, দেখবেন বাংলাদেশে অনেক জায়গায় ডাইক্লোফেনা গ্রুপের বা ব্যাথানাশক ওষুধগুলোকে জ্বর দ্রুত কমানোর জন্য ব্যবহার করে। এটা কিন্তু মারাত্মক বিপজ্জনক। যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তিনি যদি এ ধরনের ব্যাথানাশক ওষুধ খান তার ব্লিডিং হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাকে খুব ভালো ভাবে সতর্ক থাকতে হবে। যেকোনো জ্বর হোক চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সহজে ব্যাথানাশক ওষুধ গ্রহণ করবেন না। 

এরপর কিভাবে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাকে আইসোলেট করতে হবে। মশারির মধ্যে রাখতে হবে। সাত-আট দিন পরে আশা করা যায় যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তারপর তাকে চিকিৎসকদের পরামর্শে চলতে হবে। ডেঙ্গুকে বলা হয় শহরের রোগ। অর্থাৎ এটি সাধারণত রাতের বেলায় কামড়ায়। ডেঙ্গু আলোতে বেশি কামড়ায়। সে কারণে আমরা রাতের বেলা মশারি টাঙ্গাই কিন্তু দিনের বেলা মশারি ব্যবহার করি না। সে ক্ষেত্রে মশা থাকলে দিনের বেলা যারা ঘুমাচ্ছেন, মশারে টানিয়ে ঘুমাতে হবে। ডেঙ্গু পরিষ্কার পানিতে জন্মে। ফুলের টব, ডাবের খোসা বা সম্প্রতি বৃষ্টি হয়েছে, ফ্রেশ পানি আপনার বাসায় জমে আছে, সেটা যাতে জমে না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের আশপাশে যে মানুষগুলো আছে তাদের সচেতন করা। পাশাপাশি শহরের দুই বাসার মাঝে অনেক ময়লা, পানি জমে থাকে। আপনার বাসার পাশে দুই বাসার মাঝে কোনো ময়লা বা পানি জমে আছে কি না এটা আপনি নিজ দায়িত্বে দেখে নেবেন।

ভোক্তাকণ্ঠ: স্বাস্থ্য সেবা খাতকে জনবান্ধব করতে আপনার কোনো পরামর্শ যদি জানান।

ডা. সাকলায়েন রাসেল: স্বাস্থ্য সেবা ক্ষাতকে জনবান্ধব করার জন্য অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। 

প্রথমত, যিনি চিকিৎসা দেন তারও তো সুস্থ থাকার প্রয়োজন আছে। আজকে দেখেন সারা পৃথিবীতে চিকিৎসকরা সপ্তাহে দুই দিন ছুটি পান। আমাদের দেশে চিকিৎসকদের ছুটি মাত্র একদিন। যে একদিন পান সে দিনও তিনি দেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে যাচ্ছেন রোগী দেখার জন্য। ফলে তার বিশ্রাম নেই। যে মানুষটা অন্যকে ভালো রাখবে সে যদি নিজেই অসুস্থ থাকে তাহলে তো তার অন্যকে সুস্থ রাখাটা কঠিন। সে ক্ষেত্রে যারা চিকিৎসক আছেন সরকারি-বেসরকরি পর্যায়ে তাদের সপ্তাহে দুই দিন ছুটি রাখা উচিৎ। সারা পৃথিবীতে বন্ধ রাখে, সেখানে কি হাসপাতাল চলে না? আমরা যদি দুই দিন বন্ধ রাখি তাহলে ওই দুই দিন কি হবে? রোটেশন ভিত্তিতে চিকিৎসক সেখানে কাজ করবেন সেই সিস্টেমটা দাঁড় করানো প্রয়োজন। 

দ্বিতীয়ত, যে চিকিৎসক আপনাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন, আমরা চিকিৎসক বলতেই মনে করি গাড়ি-বাড়ি অনেক কিছু। সে সংখ্যাটা কতটুকু। আজকে জুনিয়র চিকিৎসকদের বেতন কত? ১০ হাজার, ১৫ হাজার, ২০ হাজার। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় বেশির ভাগ ২০ থেকে ২৫ হাজারের মতো। জেলা উপজেলা পর্যায়ে তো আরও কম। ১৫ হাজারের উপরে বেতনই নেই। এতো কষ্ট করে, এতো টাকা ব্যয় করে একজন চিকিৎসককে পড়তে হয়, সংসারের ঘানি টানতে হয়, তার যদি আর্থিক সিকিউরিটি না থাকে তাহলে তার স্বাভাবিক ভাবেই সেবার মানসিকতা কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে জুনিয়র চিকিৎসকদের বেতন বিশেষ করে ক্লিনিকে যারা কাজ করছেন তাদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা উচিৎ অন্তত ৪০ হাজার টাকা। এর বাইরে আমি মনে করি সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় আনা দরকার। 

আজকে যিনি সরকারিতে কাজ করছেন রিটায়ারমেন্টের পরে তো তিনি বেসরকারিতেই কাজ করছেন। সুতরাং বেসরকারি খাতকে অনেক বেশি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এটাকে যেমন জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। একইসঙ্গে এটার পাশে সরকারকে দাঁড়ানো প্রয়োজন। আমি মনে করি স্বাস্থ্যখাতে যারা আছেন, আমাদের দেশে দেখা যায় যে কোনো একটি বিষয়ে অনেক বেশি বিশেষজ্ঞ আছেন কিন্তু অন্য একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সংখ্যা অনেক কম। সে ক্ষেত্রে একটা রিচার্জ থাকা উচিৎ যে কোন বিষয়ে আমাদের কতগুলো বিশেষজ্ঞ রাখা প্রয়োজন। তাদেরকে সেটা করতে হবে। 

সারাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখি চিকিৎসকদের সংখ্যা কম। তার থেকে নার্সের সংখ্যা কম। চিকিৎসার বড় একটা অংশ নার্স। এই নার্সদের যদি দক্ষ নার্স হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাদের সংখ্যা যদি বাড়ানো যায়, তাদের সংখ্যা যদি পর্যাপ্ত করা যায় তাহলে সেবার মান এমনিতেই বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে আমাদের প্রচুর মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রয়োজন। 

https://youtu.be/OxcMH2_lqpQ