নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি এখন নিম্নমুখী। বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে বলা যায় না। পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো যে কাজ করছে, তাতে কতটা সুফল আসবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী- এসব নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

প্রশ্ন : দুই মাস আগে সরকার তিনটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়, কিন্তু বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। নিত্যপণ্যের সরকার নির্ধারিত দর কার্যকর হয়নি। এর কারণগুলো কী দেখছেন আপনি?

গোলাম রহমান: দেশের অর্থনীতি এখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপে আছে। প্রায় সব পণ্য ও সেবার মূল্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। চাহিদা বৃদ্ধি, সরবরাহ সংকট অথবা অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বাজারে অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির মুখ্য কারণ নয়। এসব বড়জোর উপসর্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল্য নির্ধারণ করে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। প্রসঙ্গত, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণের এখতিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের।

প্রশ্ন: মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজারে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এভাবে অভিযান চালিয়ে কি বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

গোলাম রহমান: কৃত্রিম সরবরাহ সংকট রোধে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার অভিযানের কোনো বিকল্প নেই। বাজারের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির মুখ্য কারণ মুদ্রাস্ফীতি। এ ক্ষেত্রে অভিযানের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা তেমন ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

প্রশ্ন: মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা বা যে কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে, তা রোধে কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

গোলাম রহমান: বৈশ্বিক কারণে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সূচনা হয়েছে। পরে অভ্যন্তরীণ নানা কারণে তা ঘনীভূত করেছে। বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি এখন নিম্নমুখী। বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমান বছরের বাজেটে ৬ শতাংশ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বছরের প্রথম তিন মাসে মুদ্রাস্ফীতি ছিল প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশেরও অধিক। বিভিন্ন দেশ মুদ্রানীতি, সুদনীতি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, রাজস্বনীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় লাগসই পদক্ষেপ গ্রহণ করে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণে এখনো দিধাগ্রস্ত। আশা করা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের অনুসৃত মুদ্রা, রাজস্ব, আর্থিক, সুদ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার নীতি দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়ন করা হলে ক্রমান্বয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমে আসবে।

প্রশ্ন: মুক্তবাজার অর্থনীতির বাস্তবতায় বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলো আপনি কিভাবে দেখছেন?

গোলাম রহমান: সরকার মূলত মূল্য নির্ধারণ, বাজার অভিযান, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে আমদানিনির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতিতে যাতে সংকট সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। তবে ইতিবাচক এসব পদক্ষেপ মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানায় খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে বলা যায় না।

প্রশ্ন : পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকার কী উদ্যোগ নিতে পারে?

গোলাম রহমান : দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের, বিশেষ করে কৃষিপণ্যের, পর্যাপ্ত উৎপাদন, মজুদ এবং নিরাপদ ও অবাধ পরিবহন নিশ্চিত করা। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কম খরচে স্বল্প জমিতে অধিক পণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করা। এ ক্ষেত্রে উন্নতমানের বীজ, সুষম সার, প্রয়োজন অনুযায়ী সেচের ব্যবস্থা এবং উন্নত কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রশিক্ষণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণা এবং মাঠ পর্যায়ে প্রচার ও ব্যবহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

প্রশ্ন: সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো যেভাবে কাজ করছে, তাতে কি কোনো সুফল আসবে বলে মনে হয়?

গোলাম রহমান: সরকারের তদারকি কৃত্রিম সরবরাহ সংকটের মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, বাজারে বর্তমান অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, টাকা-ডলারের বিনিময় হারে মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে উপযুক্ত মুদ্রা, সুদ, রাজস্বনীতি গ্রহণে অনীহা বা ব্যর্থতা ও সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে অব্যাহত আছে। এ ক্ষেত্রে বাজার তদারকিতে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর তেমন কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন: সরকার ডিম ও আলু আমদানির ঘোষণা দেয়। এ ধরনের আমদানি বাজার নিয়ন্ত্রণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে?

গোলাম রহমান: বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে অবাধ বাণিজ্য এবং শূন্য অথবা অতি স্বল্প আমদানি শুল্ক বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধিতে এবং ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও মূল্য হ্রাসে বিশেষ সহায়ক। সে বিবেচনায় ডিম ও আলু আমদানির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক মনে করি। তবে বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং দেশে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ডিমসহ সব কৃষিপণ্যের দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। সরকারকে ডিমসহ সব কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নীতি সহায়তা প্রদান এবং বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টিতে যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন: বাজার নিয়ন্ত্রণে কী করা দরকার বলে মনে করেন?

গোলাম রহমান: সময়োপযোগী মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা বাজার স্থিতিশীল রাখার পটভূমি তৈরি করে। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পর্যাপ্ত পণ্য উৎপাদন, মুক্ত আমদানি নীতি, শূন্য অথবা স্বল্প আমদানি শুল্ক আরোপ, অবাধ সরবরাহ চেইন, বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বাজার স্থিতিশীল রাখে।

প্রশ্ন: মুক্তবাজার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি খাত। এখানে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় প্রতিযোগিতার পরিবেশে। কৃষিপণ্যের দাম বাজারের মোট চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। কৃষিপণ্যের অকস্মাৎ দাম বাড়ার মূল কারণ কি শুধুই চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান?

গোলাম রহমান: বর্তমানে মূলত মুদ্রাস্ফীতির ফলে সব পণ্যের দামই কমবেশি বাড়ছে। তবে কৃষিপণ্যের ভোক্তা ও উৎপাদক পর্যায়ে ব্যাপক মূল্য পার্থক্যের কারণ অধিক সংখ্যায় মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর উপস্থিতি, অত্যধিক পরিবহন ব্যয়, গুদামজাত করার অপ্রতুল ব্যবস্থা, নানা নিয়ম বহির্ভূত চাঁদা পরিশোধ ইত্যাদি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা অজুহাতেও কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্ন: কৃষিপণ্যের দাম ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে গেলে কী করতে হবে?

গোলাম রহমান: উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। আমদানি বৃদ্ধি এবং শুল্ক হ্রাস মূল্য হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে যেকোনো পণ্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে ভোক্তা সে পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকে বা ক্রয়ের পরিমাণ হ্রাস করে। আবার কেউ কেউ বিকল্প পণ্য ক্রয় করে প্রয়োজন মেটায়।

প্রশ্ন: অনেকে বলেন বাজারকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ করতে দিতে হবে, গোডাউনে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আপনার কী মনে হয়?

গোলাম রহমান: বাজার সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের অর্থনীতি যদি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো যদি সন্তোষজনক হয়, বাজারে যদি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকে এবং সুশাসনের পরিবেশ থাকলে বাজারকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে দেওয়া সর্বোত্তম পন্থা। অনৈতিকভাবে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে অতি মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টা রোধে গোডাউনে অভিযানের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ শাস্তি প্রদান যুক্তিযুক্ত।

সৌজন্যে, কালের কণ্ঠ।