‘সরকারের কৌশলগত অবস্থানই বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় বৃদ্ধির জন্য দায়ী’

জ্বালানিসহ নানা সংকটের মধ্যেই রেকর্ড সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছে বর্তমান সরকার, যার মধ্যে রয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট। তবে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্যে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এদিকে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ বাড়লেও জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে বরাদ্দ ধরা হয়েছে মাত্র ৯১১ কোটি টাকা।

আসলে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ বাড়লেও জ্বালানি খাতে কেন উল্টো চিত্র? ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভোক্তার জ্বালানি অধিকার কেমন হতে যাচ্ছে? অথবা জ্বালানি নিরাপত্তা নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন? এ সকল বিষয়ে ভোক্তাকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল বিভাগের ডিন ও কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এস এম রাজিব

ভোক্তাকণ্ঠ: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি বাজেট রয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এবারের বাজেট কতটা ভোক্তাবান্ধব?

শামসুল আলম: বড় বাজেট দেওয়াটা সরকারের জন্যে খুশির খবর, যা সরকারের ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যে আমরা শুনতে পাই। কিন্তু বাজেটের আকার যত বড় হয়, ভোক্তারা তত বেশি আতঙ্কিত হয়। সুতরাং এবারেও ভোক্তারা বেশি আতঙ্কিত হয়েছে এই কারণে যে, বাজেটের অর্থ সংরক্ষণ হবে যেই প্রক্রিয়ায় সেখানে প্রথমত পণ্যের মূল্য বাড়বে, টাকার অবমূল্যায়ন হবে এবং সেই অবমূল্যায়নে মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা কমবে। এমনিতেই এক-আধ বছর আগেও ১ ডলারের বিনিময়ে ৮৫/৮৬ টাকা পাওয়া যেত, কিন্তু টাকার মান এতো বেশি কমে গেছে যে বর্তমানে সরকারি ভাবেই ১০৮ টাকা দেওয়া হচ্ছে, যা বেসরকারি ভাবে ১১২ টাকায় পৌঁছেছে। এরপরও যদি টাকার মান আরও কমে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের উপর এর প্রভাব চরম ভাবে পড়বে। এতে পণ্যের মূল্য আরও বেড়ে যাবে এবং ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাবে। সরকার ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে লোন নেবে। লোন নিলে প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ প্রবাহ বাড়বে। ফলে আমদানি বা শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পাশাপাশি ঘাটতি পূরণের জন্যে সরকার টাকা ছাঁপাবে। হয়তো দেখা গেলো ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাঁপালো, সেটাও একটা আতঙ্কের ব্যাপার। কারণ টাকা ছাপানো মানে টাকার মান কমে যাওয়া। সুতরাং এই সকল কারণে আমরা ভোক্তারা এতো বড় বাজেট নিয়ে আতঙ্কিত, সরকার যদিও এতে আনন্দিত।

ভোক্তাকণ্ঠ: বাজেটে পরিচালনা খাতের ধরা হয়েছে ব্যয় চার লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা, আর দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে। আসলে এই বিপুল পরিচালন ব্যয় সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

শামসুল আলম: প্রথমত সরকারের পরিচালন ব্যয় মানে যেটাকে প্রশাসনিক ব্যয় বলে, সেটি সংকোচন করা জরুরী ছিল। আমরা সবদিক থেকে এমনিতেই আর্থিক সংকটে আছি। এখানে আমদানি ব্যয় বাড়ছে, আবার রপ্তানি আয় কমছে। এটা একটা ভারসাম্যহীনতার শিকার। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ রিসোর্স ট্যাক্স-ভ্যাট থেকেও সরকারের আয় কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ সরকার যে পরিমাণ প্রত্যাশা করছে, সেই পরিমাণ আয় করতে পারছে না। সুতরাং সেই বিষয়টি লক্ষ্য রেখে সরকারের উচিৎ ছিল বাজেটে ব্যয় সংকোচন করা।

অতীতে দেখা গেছে যে, সরকার নিয়োগ বন্ধ রেখেছে, নানা উপায়ে সরকার তার নিজস্ব ব্যয় সংকোচন করেছে, ব্যয়ে সাশ্রয়ী হয়েছে। সেই জায়গা থেকে এবারের বাজেটে দেখা গেছে যে, সরকার উদার নীতি গ্রহণ করেছে। বিচার বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, প্রচুর পরিমাণে প্রশাসনিক ব্যয় অপচয় হচ্ছে, অদক্ষতার কারণে সম্পদের অপচয় বাড়ছে। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে যে, ঘুষ-দুর্নীতিও চলছে। এ সমস্ত প্রক্রিয়ায় অর্থ আত্মসাৎ হচ্ছে, যার কারণে সরকারের খরচও বাড়ছে। এই খরচ যদি নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তাহলে সরকারের রাজস্ব বাজেট এতো বড় হতো না।

সরকারের ব্যয়ের আকার পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সরকার তার দক্ষতা অর্জনে বিশেষত অর্থ ব্যয়ে মানসম্মত নয় এবং সক্ষমতা অর্জনেও প্রশ্নবিদ্ধ, সেই সঙ্গে দুর্নীতি দমনেও সরকার সফল নয়। সুতরাং এতো বড় আকারের রাজস্ব বাজেট নিয়ে সরকার সিরিয়াস নয়। এই সংকট মোকাবেলায় সরকারকে অবশ্যই সাশ্রয়ী হতে হবে এবং পরিচালনা ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের জন্যই ৩৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?

শামসুল আলম: বিদ্যুৎ খাতে যে সমস্ত ডেভেলপমেন্ট পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সে সমস্ত পরিকল্পনায় ডলার সংকটে যেখানে জ্বালানি সংস্থান করা যাচ্ছে না সেখানে বিদ্যুৎ খাতসহ অন্যান্য খাতের উন্নয়ন ব্যয়ের গতি কমানো উচিৎ ছিল এবং এই ব্যয় সাশ্রয় করে জ্বালানি আমদানি বা উৎপাদনে বিনিয়োগ করা দরকার ছিল। সরকারের জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল রয়েছে, যেখান থেকে জ্বালানি আমদানির জন্যে ব্যয় করা হয়। কিন্তু গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ব্যয়ে সরকার কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। এই তহবিলের অর্থ ব্যয় করে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান বা উত্তোলন আশানুরুপ হয়নি বা সফলতা নেই বললেই চলে।

এছাড়াও, পিডিবির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থ ব্যয়েও সরকার সফলতা দেখাতে পারেনি। যদিও সেই তহবিলের অর্থ ব্যয় করে বিবিয়ানায় লো-কস্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, সেটা একটা সফলতা। কিন্তু ভোলাতে গ্যাস সারপ্লাস থাকা সত্ত্বেও সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং বেসরকারি খাতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনেই সরকার বেশি মনোনীবেশ করেছে। কিন্ত সরকারি খাতে লো-কস্ট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার যদি মনযোগী হতো তাহলে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা বা ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। সুতরাং বিদ্যুৎ উন্নয়ন খাতে সরকারের কৌশলগত অবস্থানই বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

ভোক্তাকণ্ঠ: গত অর্থবছরের চেয়ে এবার বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ বাড়ানো হলেও জ্বালানি ও খনিজসম্পদ খাতে কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ বরাদ্দ। কিন্তু এ খাতে কমানোর ফলে জ্বালানি সংকট বাড়বে কি না?

শামসুল আলম: জ্বালানি খাতে বরাবরই কোনো বরাদ্দ থাকেনি। কারণ জ্বালানি আমদানি নির্ভর হলে ব্যাংক থেকে লোন নেবে, সেই লোনে জ্বালানি আনা হবে। জ্বালানি বিক্রি হবে। এখান থেকে যা আয় হবে, সেখান থেকে লোন পরিশোধ করবে। আর এই হচ্ছে জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল। তবে এটা আসলেই গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয় বিষয় হলো- দেশীয় জ্বালানির উৎস বা রিসোর্স অনুসন্ধানে এবং উত্তোলনে নিয়মিত বরাদ্দ থাকা দরকার ছিল, সেটি নবায়নযোগ্য বা অনবায়নযোগ্য যেটিই হোক না কেন। জ্বালানি আমদানি নির্ভর, দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি উত্তোলন করা এবং উত্তোলন বৃদ্ধির যদি পরিকল্পনা থাকতো সেই ক্ষেত্রে জ্বালানি খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি কম বেশি হলেও এ সংকটের সৃষ্টি হতো না। এখানে সাগরের গ্যাস বা স্থলভাগের গ্যাস অথবা কয়লা উৎপাদন, এমনকি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সরকারের প্ল্যানিংয়ে তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি। সংকট সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সুতরাং বাজেটে জ্বালানি খাতের বরাদ্দ কম বা বেশি করার কারণে জ্বালানি সংকটের কোনো সংযুক্তি নেই।

ভোক্তাকণ্ঠ: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভোক্তার জ্বালানি অধিকার নিশ্চিতের সম্ভবনা কতটুকু বা এর জন্য করণীয় কি?

শামসুল আলম: ভোক্তার জ্বালানি অধিকার বলতে আমরা ক্যাব থেকে যেটি বলেছি- যৌক্তিক, সাশ্রয়ী ও ন্যায্যমূল্যে ভোক্তার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রাপ্তির অধিকারই হচ্ছে ভোক্তার জ্বালানি অধিকার। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় অনুসন্ধান, উৎপাদন এবং আমদানি পর্যায় থেকে শুরু করে ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন পর্যায় পর্যন্ত যে ব্যয় হচ্ছে, সেগুলো ন্যায্য এবং যৌক্তিক কি না- তা যাচাই বাছাই করে এ সমস্ত ব্যয়ের সঙ্গে যে সমস্ত অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় এবং অদক্ষতা ও দুর্নীতিজনিত ব্যয় রয়েছে তা পরিহার করে যৌক্তিক ও ন্যায্যমূল্যে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলেই ভোক্তার জ্বালানি অধিকার নিশ্চিত হয়। কিন্তু সেই জায়গা থেকে সরকার এখন পর্যন্ত সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জ্বালানি খাত দেখছে না।

আমরা আরও বলেছি- খাদ্য নিরাপত্তার মতো জ্বালানি নিরাপত্তাকেও একই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। খাদ্যকে যেমন বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখতে পারি না বা ফুড সেক্টরকে যেমন বাণিজ্যিক খাত হিসেবে দেখিনা। তেমনি জ্বালানি খাতকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে দেখলে আজকের সমস্যা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এখাতেও খাদ্য খাতের মতো কস্টভিত্তিতে এবং যৌক্তিক ব্যয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের রেভিনিউ আর্নিং উৎস হিসাবে এ খাতকে বিবেচনা করা যাবে না। এখাতে সরকার ভর্তুকি দেবে না বলে জানিয়েছে, আমরাও চাই না- এখাত ভর্তুকি দিয়ে চলুক। তবে সংকট নিরসন এবং ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে এ খাত থেকে রাজস্ব আহরণ এবং মুনাফা গ্রহণ থেকে সরকারকে বেড়িয়ে আসতে হবে। সরকারি কোম্পানিগুলো যে মুনাফাভিত্তিক সেবা দিচ্ছে, তাদেরকে মুনাফা বর্জিত সেবা দিতে হবে। এগুলো বিবেচনা না করলে জ্বালানি অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। দ্বিতীয়ত- দেশীয় উৎস থেকে (স্থল-সাগর) দ্রুত এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উত্তোলন এবং ব্যবহারের জন্য পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু তার সবই এই বাজেটে এবং সরকারের পরিকল্পনাতেও অনুপস্থিত রয়েছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: জ্বালানি নিরাপত্তায় এবারের বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন? সেটা পাচ্ছে কি না?

শামসুল আলম: স্রেডার কার্যক্রমের সঙ্গে এই পরিকল্পনা বা বক্তব্যের কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। রিনিউবল এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের গতি নেই। সরকার এবং স্রেডা বলছে- ৪/৫ টাকার মধ্যে নেট মিটারিং পলিসি বা ওপেক্স মডেলের আওতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। শুধু গ্রিড বেজড রুফটপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্য ক্ষমতা বলা হচ্ছে ৫০ হাজার মেগাওয়াট, পাশাপাশি বায়ু থেকে ৩০ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ ৮০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা সম্ভব বলে সরকারের স্টাডি থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ কমার্শিয়ালী উন্নত করা এবং তার জন্য গবেষণা করা বা সক্ষমতা উন্নয়ন করার জন্যে যে সমস্ত ইন্সটিটিউশনাল কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার এবং ক্যাপাসিটি বিল্ডআপ করা দরকার সে সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। সুতরাং উদ্যোগবিহীন এ পরিকল্পনা প্রস্তাবটি অনর্থক বা অর্থবহ নয়।

ভোক্তাকণ্ঠ: ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে ৪০ শতাংশ। এটা কতটা সম্ভব হবে, আর এতটা চাহিদা তৈরি হবে কি না?

শামসুল আলম: জ্বালানি নীতিতে সরকারের পলিসিতে ১০ শতাংশের কথা বলা আছে। পরিবর্তীতে যে সকল মাস্টারপ্লান গ্রহণ করা হয়েছে সেখানেও অলমোস্ট ১০ শতাংশই আছে এবং ২০৪০ সালে ১৫ শতাংশের কথা বলা হচ্ছে। আসলে এসব পার্সেন্টেন্স বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে- প্রথমত এ খাতকে প্রতিযোগীতাহীন করে ফেলেছে সরকার এবং এ খাত অলিগোপলী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখাতে লুণ্ঠনের সংস্কৃতি বা চর্চা হচ্ছে মূলত দুটি আইনের কারণে। এর একটি হচ্ছে দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন-২০১০, আরেকটি হলো- বিইআরসি আইন পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়া অর্থাৎ আমলাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। এই দুটো জায়গা থেকে আইনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে জ্বালানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি রিনিউয়েবল এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে জ্বালানির বাজার সকল বিনিয়োগকারীদের জন্যে সমতা নিশ্চিত করা ব্যাহত হচ্ছে এবং এ কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন অসমতার শিকার হচ্ছে। সেই বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণে প্রাইভেট সেক্টরে এখন ৭ টাকা সাড়ে ৭ টাকায় গ্রিড সোলার ইলেকট্রিসিটি সরবরাহ করার প্রস্তাব নিয়ে তারা দ্বারে দ্বারে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তারপরও এই বাজার তৈরি হচ্ছে না বা এ বাজার সংকুচিত হয়ে বসে আছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসছে, আরও আনার পরিকল্পনা চলছে। নেপাল, ভূটান থেকেও বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। আসলে আমদানির বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

শামসুল আলম: আমদানি নির্ভরতা জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং, যেটা কিছু দিন আগে আমরা নেপালের ক্ষেত্রে দেখেছি। নেপাল জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারতের জ্বালানির উপর নির্ভরশীল ছিল। যখন কোনো কারণে তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিল, তখন দেখা গেল নেপালের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। যদি জ্বালানি সমস্যা সমাধানের জন্য সে সময় চীন থেকে নেপাল সহযোগিতা না পেত, তাহলে নেপালে কি ধরনের পরিণতি হতো- ভাবাও যায়না। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই একটা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে জাতীয় ভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়া উচিৎ। তবে জ্বালানি মিক্সিংয়ে জ্বালানি আমদানির একটা ফাংশন থাকতে পারে, তবে সেটা চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। যাতে কোনো কারণে যদি সে জ্বালানি না পাওয়াও যায়, তাতে এমন ভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে দেশ সংকটের শিকার না হয়।

ভোক্তাকণ্ঠ: বর্তমানে দেশে জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ডলার সংকটে বিল পরিশোধ করতে না পারায় জরিমানা গুনতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। কেন এই সমস্যার সৃষ্টি হলো?

শামসুল আলম: রপ্তানী আয় এবং আমদানি ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা অর্থাৎ আয় বুঝে ব্যয় না করা। ব্যয় বুঝেতো আর আয় করা যায় না। কিন্তু আমরা সেই উল্টোটা করে যাচ্ছি এবং এখনো বাজেটে ব্যয় দেখাচ্ছি। আর সেই ব্যয় দেখে আয় করার চেষ্টা করছি। এজন্য অসামঞ্জস্য ও অযৌক্তিক কর আরোপ করছি এবং সাধারণ মানুষের জন্য করের চাপ বাড়াচ্ছি। কিন্তু সেইভাবে কোন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করছি না। সুতরাং আয় বুঝে ব্যয় করতে না পারলে ব্যয় বাড়ে এবং ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। আমাদের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও এই ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আমদানি ব্যয় বাড়াচ্ছি। কিন্তু সেই ভাবে রপ্তানি আয় বাড়াতে পারছি না। পাশাপাশি ডলার পাচার হচ্ছে, সেটাও ঠেকাতে পারছে না। যা আয় করছি সেটাও যদি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারতাম বা তসরুপ ঠেকাতে পারতাম তাহলেও খানিকটা স্বস্তি পেতাম। সেটাও পাচ্ছি না।

ভোক্তাকণ্ঠ: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের অন্যতম আলোচিত বিষয় আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত পূরণ বা ভর্তুকি কমানো। এবারের বাজেটে জ্বালানি খাতে বিদেশি এ ঋণদাতা সংস্থার প্রভাব কতটুকু পড়েছে?

শামসুল আলম: আইএমএফের শর্তাবলি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জায়গায় নিজের থেকেই সরকারের সংস্কারে যাওয়ার কথা। হঠাৎ করে তাৎক্ষণিক এক বছরে এই সংস্কার করা সম্ভব নয় এবং সেটা করতে গিয়েই আরও জটিলতা বেড়েছে। যেমন বিদ্যুৎ খাতে হঠাৎ করেই সরকার দাবি করলো যে জ্বালানি খাতে এলএনজি আমদানির জন্য ভর্তুকি লাগছে, ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুতে ভর্তুকি লাগছে। হঠাৎ করে যদি বলা হয়- এই ভর্তুকি তুলে দিতে হবে এবং মূল্য বৃদ্ধি করে সমন্বয় করতে হবে। আবার যখন মূল্য বৃদ্ধি করা গেল না, তখন ঘাটতি সমন্বয় করার জন্যে আলটিমেটলি জ্বালানি আমদানি কমিয়ে ফেলতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে হবে। উৎপাদন কমিয়ে ঘাটতি কমাতে হবে। ঠিক আমরা দুই বছর ধরে সেই জায়গাতেই আটকে আছি। যে কারণে উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্বেও আমরা জ্বালানি আমদানি করছি না শুধু ডলার সংকটের কারণে। আবার ডলার সংকটের কারণেই যে করছি না, তাও কিন্তু শতভাগ সত্যি নয়। আমরা অন্য খাতের ব্যয় কমিয়ে জ্বালানি খাতে ব্যয় বাড়াতে পারতাম বা তাতে কিছুটা সুরাহা হতো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। এখানে মূল্য বৃদ্ধি করে ঘাটতি সমন্বয় করতে পারছি না। আর মূল্য বৃদ্ধি করলেও তো ডলার পাচ্ছি না। সুতরাং এই জায়গা থেকেও বলা যায়- আমদানি কমানো অর্থাৎ জ্বালানি সংকট ইনভাইট করা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর চাপ সেখান থেকে এসেছে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে- অনেকগুলো পাওয়ার প্লান্ট উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন না করতে পারলেও আমরা উৎপাদনে এনেছি। এস আলমের পাওয়ার প্লান্ট চার দিন চলার পরেই বন্ধ হয়ে গেছে, তাহলে সেটা উৎপাদনে যাওয়ার কোনো দরকার ছিল না। পায়রা পাওয়ার প্লান্ট যখন চালু হয়েছে, তখন সেটা চালু করার দরকার ছিল না। কিন্তু কায়কোয়াস সাহেব পায়রা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকার কারণে জোড়াজুড়ি করে চালু করেছে এবং মাসে ১০০ কোটি টাকা করে বাড়তি ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে। এই যে বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ খাতকে বেশি নাকাল করে ফেলেছে এবং এখানে যৌক্তিক চার্জ অপেক্ষায় অনেক বেশি চার্জ আরোপ করা হয়েছে। আর এই কালচারটা আসছে মূলত রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেনার প্রবণতা থেকে। এই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে দেখা গেছে যে, ওভারঅল ১৮ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা দেওয়া হয়েছে। ইকুইটি মানির উপরও ওইরকমই দেওয়া হয়েছে। ইকুইটি মানি আসছে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই ইকুইটি মানির উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে- পণ্য কেনার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়েছে, তার অর্ধেক টাকায় পণ্য কিনছে আর অর্ধেক টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলো ইকুইটি মানি হিসেবে অর্থাৎ ব্ল্যাক মানি হোয়াইট হয়ে এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে। এ ধরনের নানাবিধ কারণের পেছনে তারা কাজ করছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সাধারণ নাগরিকদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না?

শামসুল আলম: সরকারের নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এতো বড় রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের ভোগ ব্যয় কমে গেছে। তারপরও টাকার মান যদি আরও কমতে থাকে। কারণ অভ্যন্তরীণ পণ্যের বাজার ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে একটা নির্দিষ্ট পণ্যের উপর থেকে সপ্তাহের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এসব সমস্যা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে মানুষ পণ্য বা সেবা কেনা কমিয়ে ফেলবে অর্থাৎ ভোগ ব্যয় কমে যাবে। ভোগ ব্যয় যত কমবে ট্যাক্স, ভ্যাট তত কমে যাবে। অর্থাৎ সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। গত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার কারণে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। এবার তার থেকেও মারাত্বক ভাবে কমে যাবে। তখন সরকার ব্যাংক লোন নেবে এবং এই লোন যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাবে, তখন সরকার টাকা ছাপাবে। আর এই জায়গাই হচ্ছে আশঙ্কা। অলরেডি ৭০/৮০ হাজার কোটি টাকা ছেপে মার্কেটে দিয়েছে, যার কারণে মূল্যস্ফিতিও বেড়েছে। কিন্তু এবার যদি ১০০/১৫০ কোটি টাকা ছেপে বাজারে ছেড়ে দেয় তাহলে ভয়ংকর অবস্থা হবে। সরকার এমনিতেই দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেটের কথা বলেছে, তবে তারপরও আরও বাড়বে। আর সরকার যদি এই বাজেটের আকার ছোট না করে তাহলে ঘাটতি পূরণে লোন নিতে হবে এবং টাকা ছাপাতে হবে। তাছাড়া এই অর্থের সংকুলান কোনো ভাবেই করা যাবে না এবং সেটা হলে জনগণ আরও বেশি বিপদে পড়বে।

ভোক্তাকণ্ঠ: কয়লা সঙ্কটে একাধিক বার বন্ধ করতে হয়েছে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো, গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোরও একই অবস্থা। দেশের আমদানি নির্ভর এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ভবিষ্যৎ কেমন হবে?

শামসুল আলম: ১৯৯০ সালের দিকে বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়েছিলো নিজস্ব কয়লা থেকে। নিজস্ব কয়লার উৎপাদন যে বাড়ানো যেত না- তা নয়। কিন্তু কখনোই বাড়ানো হয়নি। উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েও কোনো কাজ করা হয়নি। ২০১৮ সালে বড় পুকুরিয়া কয়লার উত্তোলন অলরেডি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও বাড়তি কয়লা উত্তোলনের জন্য এডিশনাল কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। অথচ সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০ থেকে ২৭৫ মেগাওয়াট করা হয়েছে। ক্ষমতা বাড়িয়েও কয়লার উৎপাদন বাড়ানো হয়নি। তার মানে সেখানে কয়লার উৎপাদন ক্ষমতা সিংহ ভাগই ব্যবহার হচ্ছে না। অর্থাৎ সেটা আন্ডার লোডে চলছে। অবশ্য সেখানে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট না থাকলেও ডেফিসিয়েশন আছে। ডেফিসিয়েশন ঠিকই দিতে হচ্ছে, যার কারণে পার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে এবং এই সকল কারণ দেখিয়ে আলটিমেটলি বিদ্যুৎ আমদানির বাজার তৈরি করা হচ্ছে। এতে করে যা হবে- আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেশি হবে, যেহেতু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বেশি দিচ্ছি। আর এরপরে বলা হবে- আমদানি করলে খরচ কম পড়ে এবং আদানির বিদ্যুৎ আমদানি করা যায়। যেহেতু আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে, তাই তখন আমদানি বাজারকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় এ মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে ভোক্তা কতটুকু উপকৃত হবে?

শামসুল আলম: আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের দেশে তাৎক্ষণিক ভাবে তড়িঘড়ি করে সমন্বয় করা হয়। আর এখন সরকার ভর্তুকি না দেওয়ার কারণে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারটি থাকে। কিন্তু দেশে যেহেতু ৪৫ দিনের জ্বালানি মজুদ রাখার বিধান রয়েছে, সেখানে না হলেও এক মাসের জ্বালানি মজুদ থাকে। অথচ সেগুলো কম দামে কেনা থাকলেও দাম বাড়িয়ে দ্রুত কার্যকর করা হয়। কিন্তু যখন দাম কমে যায়, কম দামে জ্বালানি আমদানির পরও দেশে মূল্য এডজাস্ট হয় না। সরকার মুনাফা করে, বেসরকারি খাত মুনাফা করে। সুতরাং জ্বালানি এডজাস্টমেন্টের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- অটোমেটিক জ্বালানি এডজাস্টমেন্টের ক্ষেত্রেও এই তিক্ত অভিজ্ঞতা ভেসে উঠবে। এই অবস্থা থেকে ভোক্তাকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। অর্থাৎ এই অটোমেটিক পদ্ধতিতে ভোক্তার জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।

ভোক্তাকণ্ঠ: সম্প্রতি ওমান থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে এলএনজি আমদানির দ্বিতীয় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। দীর্ঘ মেয়াদী এ চুক্তিগুলোর ফলে দেশে উৎপাদন বিমুখ নীতি সৃষ্টি হচ্ছে কি না?

শামসুল আলম: এরপরও আমরা নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধান বা উত্তোলনের ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা নিচ্ছি না বা গুরুত্ব দিচ্ছি না। আমরা এতো কঠিন অবস্থায় আছি। যেখানে জ্বালানি বুভুক্ষার শিকার হচ্ছি। দুর্ভিক্ষ অবস্থার মতো হয়ে গেছে। তারপরও এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করছি। নতুন নতুন চুক্তি করছি। অর্থাৎ নতুন চুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন ব্যবসার পথ তৈরি করে দিচ্ছি। অথচ নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধানে বাজেটে বিনিয়োগ দেখাচ্ছি না, পরিকল্পনা রিভিউ করছি না। অর্থাৎ এ থেকেই বোঝা যায়- আমরা ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছি না।

ভোক্তাকণ্ঠ: দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন-২০১০ বা রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

শামসুল আলম: এখানে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য তাদের স্বার্থে রেন্টাল বিদ্যুতের মেয়াদ বার বার বাড়ানো হচ্ছে। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে- দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন- ২০১০ তৈরি করা হয়েছেই ব্যক্তি খাত থেকে যেনতেন মানহীন বিনিয়োগ আকর্ষণ করে যাকে তাকে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তাই সেই আইন ২০২৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হয়েছে। এই আইনের কারণে ভোক্তা জ্বালানি জাস্টিস বা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই সুবিচার পাওয়ার যে বিধিবিধান ছিল, সেটাকে ব্যবহার করে আমরা (ক্যাব) ভোক্তার জ্বালানি সুবিচারের জন্য হাইকোর্টে মামলা করে যতটুকু অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম, এই আইনের কারণে সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে।

পাশাপাশি আমাদের কাছ থেকে জ্বালানির সঠিক মূল্য নেওয়া হচ্ছে কি-না, তা গণশুনানির মাধ্যমে জানানোর সুযোগ ছিল। বিইআরসি আইনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা গণশুনানিতে তুলে ধরতে পারতাম এবং সেখানে সুবিচার না পেলে আমরা আদালতে গিয়ে সেটা নিশ্চিত করতাম। কিন্তু বিইআরসির আইন পরিবর্তন করে সেই সুযোগ রোধ করা হয়েছে। তার মানে স্বাভাবিক ভাবেই এই দুটি হাতিয়ার ব্যবহার করে ভোক্তার জ্বালানি অধিকার রোধ করা হয়েছে। এর একটি হলো- দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন-২০১০ এবং অন্যটি হলো বিইআরসি আইনের সংশোধনী, যার মাধ্যমে এখন কোনো প্রকার গণশুনানি ছাড়াই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে সরকার। এই দুটি হাতিয়ারের মাধ্যমে সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিল দেওয়ার চুক্তির ফলে ভোক্তা তথা রাষ্ট্র প্রতারিত হচ্ছে কি না?

শামসুল আলম: এতে ভোক্তা শতভাগ প্রতারিত হচ্ছে। আপনি একটি পরিবহন ভাড়া করে নিয়ে আসছেন একদিন বা দুই দিনের জন্য। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি বা তেল না থাকার কারণে সে যদি আপনাকে সেবা না দেয়, তাহলে অবশ্যই আপনি তাকে ভাড়া দেবেন না। কিন্তু তারপরও সে যদি জোর করে আপনার কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে তাহলে তো আপনি অবশ্যই প্রতারিত হবেন। ঠিক একই ভাবে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে সেই কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমাকে সেবা দেয় না। অথচ আমার কাছ থেকে সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এটা কি জুলুম নয়? সুতরাং এটা বড় ধরনের অবিচার।