‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার শক্তি এই সরকারের হয়নি’

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস হয়ে গেলেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলার কারণ জানতে তার সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে।

প্রশ্ন: ০৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েকদিন নিত্যপণ্যের দাম কমে আসছিল। কিন্তু এরপরই আবার বাড়তে থাকে। কেনইবা কয়েকদিন কমলো, এখন বাড়ছেই বা কেন?

এস এম নাজের হেসাইন: ০৫ তারিখের পর ব্যবসায়ীরা ভাবছিল যারা সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়, তাদের ধরপাকড় করা হবে। তাই তারা ভয়ে পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছিল।

কমিয়ে দিয়েছিল, না কি সঠিক পর্যায়ে রেখেছিল?
এটা আসলে কমানো নয়, দাম কয়েকদিন তারা যৌক্তিক পর্যায়ে রাখছিল। পরবর্তীতে সপ্তাহ দুই যাওয়ার পরে তারা দেখলো তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা দেখলো আগের সরকারের মতোই ঢিলেঢালা ভাব। এগুলো দেখে তারা আবার পণ্যের দাম অযৌক্তিক ভাবে বাড়িয়ে দেয়। আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

আগে চাঁদাবাজির কারণে, আবার সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হতো। তারা কি আগের অবস্থায়ই আছে, না কি নতুন গ্রুপ এসেছে?
পরিবহনের লোকজনই বলছিল, পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ। আবার বাজারভিত্তিক চাঁদাবাজি যারা করতো, তাদের জায়গায় নতুন লোক এসে এখন চাঁদাবাজি করছে। তবে পণ্য পরিবহনে এখনো আগের মতো চাঁদাবাজি শুরু হয় নাই। সব মিলিয়ে আগের মতো চাঁদাবাজি হচ্ছে না। কিন্তু তার প্রভাব বাজারে নাই। পণ্যের দাম বাড়ছেই।

তাহলে তো পণ্যের দাম কিছুটা হলেও কমার কথা।
হ্যাঁ, কমার কথা, কিন্তু কমছে না। আবার ১৯টি পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে তারও প্রভাব নেই বাজারে। এর কারণ হলো, বাজারে এই সরকারের এখন পর্যন্ত কোনো তদারকি নাই। দেখার কেউ নাই।

তাহলে ভোক্তা অধিদপ্তর, টিসিবি অথবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী করছে?
আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তরের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলেছি। তারা বলছে, পুলিশ প্রোটেকশন না পাওয়ায় তারা অভিযান চালাতে পারছে না। তাদের নিজেদেরও জনবলের ঘাটতি আছে। পুলিশও নাই। তাই তারা ঠিকমতো অভিযান চালাতে পারছে না।

বুধবার (০৯ অক্টোবর) থেকে তো ভোক্তা অধিদপ্তর নতুন করে অভিযান শুরু করেছে…
সরকার নতুন ভাবে একটা টাস্কফোর্স করেছে, যেটার মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর , বিএসটিআই, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ সবাইকে নিয়ে কাজ করবে। ওখানে ক্যাব ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরাও আছেন। এটা আগেও ছিল, আবার ছাত্র প্রতিনিধিদের যুক্ত করে একটু সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এটা আসলে মাঠ পর্যায়ের জন্য। তারাই অভিযান শুরু করেছে।

এর সুফল কি দ্রুতই পাওয়া যাবে?
এটার একটার সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করি। যারা মাঠ পর্যায়ে কৃত্রিম ভাবে দাম বাড়ায়, তারা জানবে যে, না মাঠে তদারকি করার কেউ না কেউ আছে।

সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। এখন সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। ভোজ্য তেলে সিন্ডিকেট। একটি বড় শিল্প গ্রুপ আবার ০৫ আগস্টের পর বলেছিল তারা বিনা লাভে ভোজ্য তেল বিক্রি করবে।

ডিমের মধ্যেও বড় কর্পোরেট গ্রুপের কারসাজি আছে। তারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। সব ধরনের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ই এখন বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপ ঢুকে গেছে। তারা এখন সিংহ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করার কারণে বাজার এখন অস্থির হয়ে আছে। তারা যে বলেছে বিনা লাভে ভোজ্য তেল দেবে, কিন্তু সংকটকালে তো এখন দিচ্ছে না। যখন দাম বেড়ে যায়, তখন কর্পোরেট গ্রুপগুলো যদি খোলা বাজারে ন্যায্যমূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি করে, তাহলে কিন্তু সেটা সরকারকে সহযোগিতা করাই হবে। কিন্তু যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখন তারা উল্টো সরবরাহ কমিয়ে দেয়।

এ প্রবণতা কি এখনো আছে? শোনা যাচ্ছে, উত্তর বঙ্গের চাতাল মালিকরা স্টক করে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে?
হ্যাঁ, ওই প্রবণতা এখনো অব্যাহত আছে। আমরা যে সিন্ডিকেটের কথা বলছি, সেটা তারাই করতে পারে, যারা পণ্যের সরবরাহ লাইন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দিলে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়, দাম বেড়ে যায়, মুনাফা বাড়ে। যারা বড় কর্পোরেট গ্রুপ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করে, তারা এই কাজ করেই মুনাফা লুটে।

অন্তর্বর্তী সরকার কি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না? এটা তো অরাজনৈতিক সরকার। তাদের ওপর তো রাজনৈতিক প্রভাব নাই।
আগের মন্ত্রীরা নাই, কিন্তু যারা আমলা, সরকারি কর্মকর্তা- তাদের অধিকাংশই কিন্তু বহাল আছে। আর এই আমলারাই কিন্তু বিগত সরকারের আমলে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়ে লুটপাটের সুবিধা করে দিয়েছে। এই ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। সেই একই সেটআপ দিয়ে আপনি অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন- সেটা আশা করা যায় না।

এক গ্রুপ হলেন ব্যবসায়ী, যারা সিন্ডিকেট করেন। আরেক গ্রুপ হলেন আমলা, যারা তাদের সহযোগিতা করেন। তাদের কিছু লোককে চিহ্নিত করে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় না? এই সরকার কি সেটা নিয়েছে?

না, সেটা তো নেয়নি। আমরা গত ১৫ বছর ধরেই আইনের শাসনের কথা বলে আসছি, যে আইনের প্রয়োগ হয় না। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের তালিকাও আছে সরকারের কাছে। তাদের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো কিছু ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিয়ে সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে। তাদের আসলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি।

এই সরকারও কি একই কাজ করছে?
এই সরকারের বিষয়টা হলো, যারা এইসব বড় বড় বাজার কারসাজির সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো শক্তি, সুশৃঙ্খল শক্তি বা সেটআপ তাদের এখনো তৈরি হয়নি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, এটা যেহেতু একটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সরকার, তাই তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, অপরাধী সে যে-ই হোক। মনে রাখতে হবে, এই যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এটা কিন্তু দেশের ১৮ কোটি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই সরকারের উচিত দেশের মানুষের পক্ষে কাজ করা।

এই যে ডিমের দাম লাগামহীন ভাবে বাড়লো এটার ব্যাপারে এই সরকার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে?
না, ওই রকম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। ভারত থেকেও ডিম আমদানি করা হচ্ছে। তারপরও দাম কমছে না। আমদানির কথা শুনে কিছুটা কমেছিল। অসাধু ব্যবসায়ী বা আমলাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। গত ১৫ বছর ধরে তাদের আমরা চিনি। তাদের যে চিহ্নিত করা যায় না তা কিন্তু নয়।

তাহলে করণীয় কী?
বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বাজার নিয়ে যারা কারসাজি করে, সেই অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে- দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আর পণ্যের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য মানুষকে জানাতে হবে। সরকারের সংস্থাগুলোকে কার্যকর করতে হবে। আগের সরকারের সময় বেশ কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই দামে পণ্য বিক্রি হয় কি না তা কেউ দেখতো না। এ রকম হলে তো হবে না।