ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে হু হু করে বেড়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম। তবে চালের দাম বাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হয়েছে জনসাধারণকে। কারণ যেখানে এক/দুই টাকা বাড়লেই হিমসিম খেতে হয় সেখানে এক লাফে কেজিতে বেড়ে গেছে পাঁচ থেকে আট টাকা।
তবে চালের এই দাম বাড়ার জন্য মিল মালিকদের দায়ী করছে ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে চালের দাম বাড়ানো হলেও চালের পরিবহন খরচ বহন করেন ব্যবসায়ীরা।
তবে মিল মালিকদের মতে, তেলের দাম বাড়ায় ধানের দামও বেড়ে গেছে। যার কারণেই বেড়েছে চালের দাম। তবে কেজিতে কয় টাকা বাড়ানো হয়েছে সে বিষয়ে তথ্য দিতে গড়িমসি করছেন তাদের।
আর বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবসায়ীদের নৈতিক অবক্ষয় এবং সরকারি তদারকির অভাবেই এই সঙ্কট।
সকলের যৌথ প্রচেষ্টায় পণ্যের দাম কমিয়ে ভোক্তা সাধারণের জন্য স্বস্তি ফিরে আনার আহ্বান জানান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন।
ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, তেলের দাম বাড়ার আগে এসিআই কোম্পানির ৫০ কেজির চালের পাইকারি মূল্য ছিল তিন হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে পাইকারদের তা কিনতে হচ্ছে তিন হাজার ৫৫০ টাকায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মন্ডল রাইসের মিনিকেটের দাম আগে ছিল তিন হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে তিন হাজার ৩০০ থেকে তিন হাজার ৩৫০ টাকা। এছাড়াও কুষ্টিয়ার রীমা মনি রাইসের ৫০ কেজির মিনিকেট তিন হাজার ১০০ টাকা থাকলেও বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে তিন হাজার ৪৫০ টাকা।
রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকার কলাপট্টি চালের আড়তের পাইকারী ব্যবসায়ী ও চৌদ্দগ্রাম রাইস এজেন্সির মালিক মো. আবুল কালাম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার আগে ৫০ কেজির মিনিকেট চালের যে বস্তা তিন হাজার ১০০ টাকা ছিল এখন তা তিন হাজার ৪৫০ টাকা হয়েছে। আর যেটা তিন হাজার ২০০ ছিল এখন সেটা তিন হাজার ৫৫০ হয়েছে। কিন্তু চালের পরিবহন খরচ তো আমরা দেই তাহলে চালের দাম বাড়লো কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দৈনন্দিন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। দিন শেষে আমাকেও কিনে খেতে হয়। কিন্তু খরচ বাড়লেও আয় তো বাড়েনি। বরং চালের দাম বাড়ার কারণে ক্রেতা কমেছে। আবার চালের দাম বাড়ার কারণে ক্রেতাদের সন্তুষ্টির জন্য লাভের অঙ্কও কমেছে।’
একই এলাকার করিম রাইস এজেন্সির ম্যানেজার রুবেল ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদেরও বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার ম্যাজিস্ট্রেট এসে আমাদেরই জরিমানা করেন। কিন্তু চালের দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা। তারা তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুক- তারা কেন দাম বাড়ালো।
অবৈধ মজুদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটা দোকানে দুই/চার দিনের চাল রাখতেই হয়। না রাখলে ব্যবসা করবো কেমনে?’
কলাপট্টি চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মাহিম এন্টারপ্রাইজের মালিক মুঞ্জু হোসেন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘চালের দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই৷ আমরা আগে যা লাভ করতাম এখনো তাই করছি। বরং আমাদের আরও বিনিয়োগ বেড়েছে। আবার দাম বাড়ার কারণে ক্রেতাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা হয়।’
বেশি দাম নেওয়ার কথা স্বীকার করে আকিজ এসেন্সিয়াল লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজার (সেলস) মো. সাব্বির হোসেন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার কারণে ধানের দাম বেড়ে গেছে। যে কারণে চাল উৎপাদনেও খরচ বেড়েছে। এ জন্য কিছুটা দামও বাড়িয়েছে কোম্পানি।’
কতো বেড়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘৫০ কেজির বস্তুায় আগের থেকে ২০০ টাকার মতো বেড়েছে।’
কুষ্টিয়ার রীমা মনি এগ্রো ফুডসের ম্যানেজার মো. হাসান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে ৫০ কেজির মিনিকেটের বস্তা তিন হাজার ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
তবে তিন হাজার ৪৫০ টাকায় বাজারে রীমা মনির মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে- ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ দামের বিষয়টি স্বীকার করেন। এ সময়ে তিনি বেশি দাম নেওয়ার জন্য ধানের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করেন।
তবে ধানের দাম কতো বেড়েছে এবং পরিবহন খরচ ব্যবসায়ীরা দেওয়ার পরও এতো দাম বাড়লো কেন- এমন প্রশ্নে মো. হাসান বলেন, ‘চালের মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে অটো রাইস মিলগুলো। বসুন্ধরা, সিটি গ্রুপ, আকিজ গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলো চালের দাম বাড়ানোর কারণে ধানের দাম বেড়ে গেছে। যার কারণে আমাদের মতো ছোট মিল মালিকদেরও বাড়াতে হয়েছে।’
অন্যদিকে মুঠোফোনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মন্ডল রাইস এন্ড ফুড ইন্ড্রাস্টিজ থেকে বলা হয়, গত কয়েক মাস যাবৎ তারা বাজারে কোন চাল বিক্রি করছে না। তাদের পুরো চাল সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
বাজারে মন্ডল রাইসের চাল দেখা গেছে- এমন প্রশ্নে তারা বলেন, এগুলো আগের চাল।
ব্যবসায়ীরা দুই/এক দিনের মধ্যে কিনেছে, এমন দাবি করা হলে তারা বলেন, এখন ব্যাস্ত আছি, পড়ে কথা বলছি। এরপর একাধিক বার ফোন করা হলেও রিসিভ করেনি।
এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার দায় দিয়ে দেশে নজিরবিহীন ভাবে দৈনন্দিন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। যার কারণে ভোক্তা সাধারণের উপর চাপ পড়েছে, যেটা কোন ভাবেই কাম্য নয়। সরকারের উচিৎ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের সংস্থাগুলোর কাজ নজরে পড়ছে। তবে শুধু সরকারের একার পক্ষে বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য কোম্পানিগুলোকেও নৈতিক ভাবে এই সঙ্কটের সময়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এবং সরকারের সংস্থাগুলোর প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবেই এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনী বাজারে অস্থিরতার কারণে মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা নেই। যার ফলে, নিম্নআয়ের এবং মধ্যম আয়ের মানুষগুলো শোচনীয় অবস্থায় পড়েছেন। তারা আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে পারছেন না। আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে খোলা বাজারের পণ্য কিনতেও পারছেন না। সরকারকে সব বিষয়েই খেয়াল করতে হবে।’