ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী। মানুষকে জিম্মি করে পণ্যের সঙ্কট দেখিয়ে একদিকে যেমন হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা তেমনি হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য। এমনকি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে দ্বিধা করছে না এসব ব্যবসায়ীরা। হৃদযন্ত্রে আক্রান্ত রোগীদেরও ছাড় দিচ্ছে না তারা।
হৃদযন্ত্রে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতিব জরুরী হার্টের ভালভ এবং পেস মেকার। জরুরী চিকিৎসায় ব্যবহৃত এসব নিয়ে প্রতারণা হচ্ছে। যা হাতেনাতে ধরেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
হৃদযন্ত্রের ছন্দের সমস্যা হলে রোগীর দেহে স্থাপন করা হয় পেসমেকার। ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক পেসমেকারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা। তবে রোগীকে জিম্মি করে একটি পেসমেকারের দাম নেওয়া হয় পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ একটি পেসমেকারে অতিরিক্ত ৬৯ হাজার টাকা বেশি নেওয়া হয়। রোগীর সঙ্গে এমন প্রতারণা করেছে দ্য স্পন্দন লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
পেসমেকার কি?
পেসমেকার হল একটি ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস যা কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া (হৃদযন্ত্রের ছন্দের সমস্যা) দূর করতে ব্যবহার করা হয়। এই ছোট্ট যন্ত্রটি বুকে বা পেটের উপরের দিকে, কখনো কখনো কলার বোনের নিচে স্থাপন করা হয়।
সম্প্রতি ভুক্তভোগী একজন রোগী দ্য স্পন্দন লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে রোববার রাজধানীর কাওরান বাজারে দ্য স্পন্দন লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের অফিসে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর।
অভিযানের নেতৃত্ব দেন ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান ও সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল এবং সহকারী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম।
অভিযানে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হার্টের ভালভ, পেসমেকারসহ বিভিন্ন চিকিৎসা ডিভাইস সরবরাহ করে দ্য স্পন্দন লিমিটেড। পেসমেকারের দাম বেশি নেওয়ার তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, পণ্য বিক্রয় রশিদের ডুবলিকেট কপি নেই। কোন পণ্যে কত মূল্য নেওয়া হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই। অতিরিক্ত দাম নেওয়ার তথ্যও পাওয়া যায় এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তা স্বীকারও করেন।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির স্টোর রুমের ফ্রিজে গিয়ে পাওয়া যায় মেয়াদোত্তীর্ণ হার্টের ভালভ। কিছু হার্টের ভালভের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে। তার পরও সংরক্ষণে রাখা হয়েছে এসব চিকিৎসা পণ্য।
ভালভ কি?
ভালভ হার্টের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হার্টে রক্ত চলাচলের জন্য কিছু ভালভ লাগে। একটি মানুষের শরীরে চারটি ভালভ থাকে- ট্রাইকাসপিড, পালমোনারি, মাইট্রাল ও অট্রিক ভালব। এই ভালবগুলোতে টিস্যু ফ্ল্যাপ বা পর্দা থাকে যা প্রতিটি হদস্পন্দনের সঙ্গে খোলে ও বন্ধ হয়। ফ্ল্যাপগুলো নিশ্চিত করে যে রক্ত হৃৎপিণ্ডের চারটি প্রকোষ্ঠের মাধ্যমে এবং সমগ্র শরীরে সঠিক দিকে যেন রক্ত প্রবাহিত হয়।
এসব অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এবং জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নিজেদের অপরাধের বিষয়ে দ্য স্পন্দন লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটির এডভাইজর বলেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ হার্টের ভালভগুলো বিক্রির জন্য নয়, এগুলো পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য সংরক্ষণে রাখা হয়েছে। তবে আমাদের ভুল হয়েছে যে আমরা পণ্যের মোড়কে নট ফর সেল লিখে রাখিনি।’
পেসমেকারের দাম বেশি নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে সময় পেসমেকারের দাম বেশি নেওয়া হয়েছিল তখন এই পণ্যটির সংকট ছিল। আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হয়েছে। তার পরও আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা পরবর্তীতে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকবো।’
অভিযানের বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ‘দ্য স্পন্দন লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানে তদন্তে এসে আমরা অনিয়ম পেয়েছি। হার্টে যে প্রেসমেকার বসানো হয় সেটার ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য চার লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু এখানে দাম নেওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ একটি পেসমেকারে অতিরিক্ত ৬৯ হাজার টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে। এছাড়া হার্টের কিছু ভালভ মেয়াদোত্তীর্ণ পাওয়া যায়। যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের মার্চ মাসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভালভের সঙ্গে ফ্রিজের মধ্যে লেবু, কাঁচা মরিচ, আমের আচার একসঙ্গে রাখা হয়েছে। পণ্য বিক্রির ক্যাশ মেমোতে কোনো কার্বন কপি নেই। কত টাকায় এসব পেসমেকার ও ভালভ বিক্রি করেছে তার কোনো তথ্য নেই। সরকারি যে দাম সে দামে বিক্রি করেছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছি না। এসব অপরাধে দ্য স্পন্দন লিমিটেডকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
-এসআর