স্যালাইনের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাল থেকে সারাদেশে কঠোর অভিযান

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: স্যালাইনের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে সারা বাংলাদেশে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে স্যালাইনের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে পাইকারি, খুচরা বিক্রেতা ও সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা কোথাও যদি অভিযান পরিচালনাকালে স্যালাইনের অবৈধ মজুদ দেখি; তবে ওই প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হবে। তারপর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে স্থায়ী ভাবে বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হবে। এছাড়াও বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নিকট সুপারিশ করা হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমিতি থেকে সদস্য পদ যেন বাতিল করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘দেশে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ডাক্তাররা এই ক্ষেত্রে স্যালাইন সাজেস্ট করেন। তাই সাম্প্রতিক সময়ে দেশীয় বাজারে স্যালাইনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সেই সুযোগে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধ ভাবে স্যালাইন মজুদ করে বাজারে স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে এবং এমআরপি অপেক্ষা বেশি মূল্যে স্যালাইন বিক্রয়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সে প্রেক্ষিতে অধিদপ্তর কর্তৃক ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশে স্যালাইনের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে অভিযান পরিচালিত হয়।

অভিযান থেকে প্রাপ্ত অসঙ্গতিসমূহ তুলে ধরে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘বেশ কিছু ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে গেলে ভোক্তাদের প্রথমে বলা হয় স্যালাইন নেই। পরবর্তীতে ভোক্তাদের নিকট অতিরিক্ত মূল্যে স্যালাইন বিক্রয় করতে দেখা যায়। এটা তো খোলা পণ্য নয়; এতে এমআরপি রয়েছে তাই অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রয় করার কোনো সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য এই সেক্টরের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নিকট আমার অনুরোধ থাকবে তারা যেন নির্লিপ্ত না থেকে এক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে রোগীর আত্মীয়-স্বজনের আবেগকে কাজে লাগিয়ে যে সব অসাধু ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশ ফার্মাসিটিক্যাল সেক্টরে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা এই সেক্টর নিয়ে গর্ব করি। সেখানে স্যালাইন নিয়ে এমন ঘটনা খুবই দুঃখজনক। স্যালাইন উৎপাদনকারী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে এই সংকটকালে স্যালাইন উৎপাদন বৃদ্ধি করায় ধন্যবাদ জানাই।’

এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘লিবরা ইনফিউশন লিমিটেড উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্বেও আর্থিক সমস্যার কারণে কম পরিমাণ স্যালাইন উৎপাদন করছে তাই আমরা লিবরা ইনফিউশনকে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী স্যালাইন উৎপাদন করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের নিকট সুপারিশ করবো।’

ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, ‘অভিযান পরিচালনাকালে স্যালাইন বিক্রির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত অসংগতি যথা, ভোক্তা কর্তৃক স্যালাইন ক্রয় করতে গেলে অধিকাংশ ফার্মেসি থেকে বলা হয় স্যালাইন নেই অথবা বিক্রি হবে না; তবে বেশি টাকা দিলে স্যালাইন বিক্রয় করে, ৮৭ টাকার স্যালাইন ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রয় করা, মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রয়ের জন্য সংরক্ষণ করা, মেয়াদোত্তীর্ণ টেস্ট কিট বা রিএজেন্ট দিয়ে টেস্ট করা, ফিজিশিয়ান স্যাম্পল বিক্রয় করা, যথাযথ তাপমাত্রায় ঔষধ সংরক্ষণ না করা ইত্যাদি বিষয় পরিলক্ষিত হয়।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘অধিকাংশ কোম্পানিগুলো এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে বা নিজেরা হাসপাতালে ঔষধ সরবরাহ করে এবং কিছু ঔষধ বিভিন্ন ফার্মেসিতে সরবরাহ করে। বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতে স্যালাইনের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সাত লক্ষ স্যালাইন আমদানির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সংকটকালীন এ সময়ে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীরা স্যালাইনের চাহিদা বৃদ্ধির এ সুযোগটি নিয়েছে। আমাদের অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মনিটরিং করছে। স্যালাইন বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের মাধ্যমে জানার সুযোগ আছে কোথায় কত মূল্যে স্যালাইন বিক্রয় হচ্ছে? ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর একটি কমিটির মাধ্যমে ঔষধের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। স্যালাইন বেশি মূল্যে বিক্রয় করা হলে প্রমাণসহ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। আমার মতে, স্যালাইনের সংকট হওয়ার কথা নয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। আইনের বাইরে কেউ নয়। যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বলেন, ‘বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতির কারণে স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত স্যালাইন মজুদ রয়েছে। তাই স্যালাইনের সংকট তৈরি হওয়ার কথা নয়। কৃত্রিম ভাবে এই সংকট তৈরি করা হয়েছে। এই সংকট তৈরির সঙ্গে কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা দরকার।’

আলোচনায় অপসোনিন, পপুলার ফার্মাসিটিক্যাল, বেক্সিমকোসহ বিভিন্ন স্যালাইন উৎপাদনকারী ফার্মাসিটিক্যালসের প্রতিনিধিবৃন্দ বলেন, বর্তমানে ছয়টি ফার্মাসিটিক্যালস কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন করে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ভোক্তার স্বার্থে আমরা পূর্বের চেয়ে বেশি পরিমাণে স্যালাইন উৎপাদন করছি। পূর্বের দুই শিফটের পরিবর্তে বর্তমানে তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করা হচ্ছে। এমনকি সাপ্তাহিক বন্ধের দিন শুক্রবারও স্যালাইন উৎপাদন করা হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক পূর্বে প্রতি মাসে ৪৪ লক্ষ স্যালাইন উৎপাদন করা হতো। বর্তমানে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে প্রতি মাসে ৫৩ লক্ষ স্যালাইন উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশে পর্যাপ্ত স্যালাইনের উৎপাদন হচ্ছে।

লিবরা ইনফিউশন লিমিটেডের প্রতিনিধি বলেন, আমাদের প্রতিদিন ৫০ হাজার স্যালাইন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতার অভাবে বর্তমানে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার স্যালাইন উৎপাদন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তার জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বরাবর আবেদন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক বলেন, স্যালাইনের ক্ষেত্রে ডিস্ট্রিবিউশন লাইনে স্বচ্ছতা নেই। কোম্পানিগুলো কোনো ইনভয়েস দেয় না। আমাদের ৮০ শতাংশ ফার্মেসি গত প্রায় দুই মাস যাবত কোনো স্যালাইন পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে স্যালাইনের সরবরাহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

এফবিসিসিআই’র অতিরিক্ত পরিচালক বলেন, বর্তমানে ভোক্তা অধিদপ্তরের কাজ প্রশংসনীয়। ডেঙ্গুর পাশাপাশি ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগের জন্য স্যালাইন দরকার। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে কেন কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হবে? অসৎ ব্যবসায়ীদের পাশে এফবিসিসিআই থাকবে না। তিনি অসৎ ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিল করার কথা বলেন। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে সকলকে সহযোগিতার করার বিষয়েও বলেন। এক্ষেত্রে জয়েন্ট এনফোর্সমেন্ট করা গেলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। তিনি পরিশেষে বলেন, এই বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এক্ষেত্রে সকলের সমন্বিত প্রয়াস দরকার।

ক্যাবের কোষাধ্যক্ষ মো. মুঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সততা ও শুদ্ধাচারের চর্চা করতে হবে। আজকের আলোচনায় আমরা দেখেছি কৃত্রিম ভাবে স্যালাইনের সংকট তৈরি করা হয়েছে। ভোক্তার স্বার্থে কৃত্রিম ভাবে স্যালাইনের সংকট তৈরি করার পেছনে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভোক্তা-অধিকার নিশ্চিতে সকল সংস্থার সমন্বিত ভাবে কাজ করতে হবে।’

বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি বলেন, ডেঙ্গুর কারণে স্যালাইনে চাহিদা কত বেড়েছে তা এই সেক্টরের জানা নেই। চাহিদা কত জানা থাকলে উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় করা সহজ হত। বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে স্যালাইনের দাম বেশি নেয়া কোনো ভাবেই কাম্য নয়। এই সভায় পরিলক্ষিত হয়েছে কৃত্রিম ভাবে স্যালাইনের এ সংকট তৈরি করা হয়েছে। স্যালাইনের মূল্য বৃদ্ধি পাবে মনে করে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী স্যালাইনের অবৈধ মজুদ করে এ সংকট তৈরি করেছে। তাই স্যালাইনের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দরকার। স্যালাইনের দাম না বাড়ানোর ঘোষণা দিলে তারা আর স্টক করবে না। তাছাড়া করোনাকালীন সময়ের মতো তাৎক্ষণিক বিনা শুল্কে স্যালাইন আমদানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’

আলোচনা শেষে স্যালাইনের মূল্য স্থিতিশীল এবং সরবরাহ যেন স্বাভাবিক থাকে সে লক্ষ্যে সকলে সমন্বিত ভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

-এসআর