ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:
ট্রান্সফ্যাট (টিএফএ) রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে ভালো কোলেস্টেরল কমায়। ফলে হৃদযন্ত্রে মাত্রাতিরিক্ত খারাপ কোলেস্টেরলের কারণে হার্ট অ্যাটাক, মস্তিষ্কের স্ট্রোক, রক্তনালীর অসুখ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ। এ কারণে ২০২৩ সালের ট্রান্সফ্যাসের পরিমাণ ২ শতাংশের মধ্যে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বের ১৫টি দেশে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু দুই-তৃতীয়াংশ। তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। এখানে প্রতি বছর হৃদরোগে যত মানুষ মারা যায়, তার চার দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি।
সরকার সম্প্রতি প্রণয়ন করা হয়েছে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১। এই প্রবিধানমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হওয়ায় ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পরে সব তেল, ফ্যাট ও খাদ্যপণ্যে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশে মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। নির্দিষ্ট ওই সময়ের পর মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ এই বিধান না মানলে তাকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা ১২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে আইন অনুযায়ী।
প্রবিধানটি করেছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কমিটির সভাপতি ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বলেন, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পরে আর মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট ব্যবহারের সুযোগ থাকছে না। গত ৬ ডিসেম্বর আমরা প্রবিধিমালা বাস্তবায়ন করতে খাদ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মিটিং করেছি। এখন হাতে থাকা এক বছরের মধ্যে আমরা একটা রোডম্যাপ প্রণয়ন করবো। যাতে শিল্পোদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে পারি। নিজস্ব ল্যাবের সক্ষমতা বাড়ানোসহ খাবার তৈরির সব স্তরেও সেটা বাস্তবায়ন এবং জনগণকে সে বিষয়ে সচেতন করতে পারি।
‘আমরা এর মধ্যে সব স্তরের খাদ্য প্রস্তুতকারীদের চিঠি ও নির্দেশনা দেবো। এ বিধান মানতে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়া হবে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের কোনো দ্বিমত ছিল না। খাদ্য ব্যবসায়ীসহ সব পক্ষের মতামতের পরই এটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তারা শুধু সময় চেয়েছিল, এজন্য এক বছর দেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট রুখতে আমরা সফল হবো।’
বেশিরভাগ ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয় শিল্পপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্যাকেটজাত, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও বেকারি পণ্যে বিদ্যমান ট্রান্সফ্যাট হলো এক ধরনের স্নেহজাতীয় খাদ্য উপাদান। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা দেয়। এতে হৃদরোগসহ বেশকিছু রোগের ঝুঁকি বাড়ে। আর বাংলাদেশে খাবারে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও)। এই উপাদান ডালডা ও বনস্পতি নামে পরিচিত। শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে রাস্তার পাশের দোকানে তৈরি খাবারেও এ ডালডা ব্যবহৃত হয়।
ফলে বাজারে ডুবো তেলে মচমচে করে ভাজা খাবার হচ্ছে ট্রান্সফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার। ডালডায় বানানো খাবারেও প্রচুর ট্রান্সফ্যাট থাকে। এজন্য মচমচে বেকারি পণ্য, চিপস, শিঙাড়া, সামুচা, জিলাপি, কচুরি, পাকোড়াসহ বিভিন্ন ফাস্টফুডজাতীয় খাবারে বেশি থাকে এ ক্ষতিকর উপাদান।
সরকারের এ প্রবিধানটি কার্যকর হওয়ার পরে চর্বির ইমালসনসহ যে কোনো তেল ও চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যে কোনো খাদ্যের উদ্দেশ্যে অথবা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যে কোনো খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত চর্বিতে ২ শতাংশের বেশি ট্রান্সফ্যাট থাকলে তা বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও আমদানি করা যাবে না। শুধু প্রাণিজ উৎসজাত ট্রান্সফ্যাটের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়।
পাশাপাশি মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের লেবেলে বাধ্যতামূলকভাবে ২০১৭ সালের মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা অনুযায়ী ট্রান্সফ্যাট সম্পর্কিত তথ্যাদি ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ মোড়কে বিভিন্ন বাধ্যতামূলক তথ্যের পাশাপাশি তখন ট্রান্সফ্যাটের মাত্রার তথ্যও উল্লেখ করতে হবে। এছাড়া খাদ্যের লেভেলিং, বিপণন বা বিজ্ঞাপনে কোনো খাদ্যপণ্য ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বা স্বল্প ট্রান্সফ্যাট যুক্ত এমন দাবি করা যাবে না।
দেশে ছোট পরিসরে যারা বেকারিপণ্য (হ্যান্ডমেড) প্রস্তুত করে তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি। সারাদেশে হাতে পণ্য তৈরি করে এমন পাঁচ হাজারের বেশি বেকারি রয়েছে এই সংগঠনের অধীনে। এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হক বেকারির স্বত্বাধিকারী রেজাউল হক রেজা বলেন, এ প্রবিধিমালার সংক্রান্ত খবর আমি টেলিভিশনে দেখেছি। আমাদের অধিকাংশ বেকারি মালিক বিষয়টি জানেন না। এ বিষয়ে আমাদের সংগঠনকে কিছুই জানানো হয়নি। এ আইনের খারাপ-ভালো দিক বা কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।
রেজাউল হক রেজা বলেন, এ প্রবিধিমালায় ছোট বেকারি সরাসরি জড়িত। আমরা যে ডালডা ব্যবহার করি তাতে ২০ শতাংশের বেশিও ফ্যাট থাকে। এর মধ্যে কতটুকু ট্রান্সফ্যাট, সেটা জানা নেই।
এ প্রবিধিমালায় বেকারি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়বে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিষ্কারভাবে ট্রান্সফ্যাটের বিষয়টি জানি না। যতটুকু খবরে দেখে বুঝেছি, তাতে ট্রান্সফ্যাট বন্ধ করলে ডালডার দামের কারণে খরচ বাড়বে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ করছে। সংস্থাটি বলছে সব ফ্যাট, তেল ও খাবারে প্রতি একশ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই গ্রামে সীমিত করতে হবে। যদিও তাদের হিসাবে বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে নীতিমালা না থাকার কারণে ট্রান্সফ্যাট ঝুঁকিতে আছে।