ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক
এহসান গ্রুপে বিনিয়োগে ধর্মীয় বক্তা, মসজিদের ইমাম ও খাদেমদের মতো ব্যক্তিদের ব্যবহার করে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পেয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ।
কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মানুষ বুঝতে পারেন, তারা প্রতারিত হচ্ছেন। এখন অনেক কষ্টের বিনিয়োগ হারিয়ে তারা ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। সম্প্রতি গ্রুপটির প্রতারণা-জালিয়াতি ধরা পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
জালিয়াতির জাল বিছিয়ে প্রতারণা করে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসানকে গ্রেফতার করে। পরে গ্রেফতার করা হয় আরও চারজনকে। র্যাব জানিয়েছে, সারাদেশে রাগীব আহসানের বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা হয়েছে।
রাগীব আহসান ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত খুলনার একটি মাদরাসা থেকে মুফতি কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পিরোজপুরে একটি মাদরাসায় চাকরি শুরু করেন। এর মধ্যে ২০০৬-২০০৭ সালে এস মাল্টিপারপাস নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি নেন। মূলত ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা কার্যক্রম রপ্ত করেন। পরে নিজে ২০০৮ সালে এহসান রিয়েল এস্টেট নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর নানান কথা আর কৌশলে চলতে থাকে তার প্রতারণা।
র্যাব সূত্র জানায়, রাগীব আহসান সুদবিহীন বিনিয়োগের বিষয়টির ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালান। ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের নামে ব্যবসায়িক প্রচার-প্রচারণা করতেন। হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেন। এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
প্রতারণার ফাঁদ ১৭টি প্রতিষ্ঠান
গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান জানিয়েছেন, তিনি ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- (১) এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, (২) এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, (৩) এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, (৪) নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, (৫) জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, (৬) হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), (৭) আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, (৮) পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, (৯) এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, (১০) মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, (১১) মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, (১২) এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, (১৩) এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, (১৪) ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট (১৫) এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, (১৬) এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার, (১৭) এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।
‘এহসান গ্রুপকে যারা বিশ্বাস করবে না তারা মুনাফেক’
স্থানীয়রা জানান, এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান তার প্রতারণা পাকাপোক্ত করতে ২০১৩-১৪ সালের দিকে সৌদি আরব থেকে একজন বক্তাকে নিয়ে আসেন। ওই বক্তার ওয়াজ মাহফিলে আশপাশের কয়েক জেলা থেকে মুসল্লিরা সমবেত হন। ওই বক্তা টানা ৪৫ মিনিটের মতো আরবিতে ওয়াজ করেন। পরে তাকে বলার জন্য রাগীব আহসান আরবিতে লিখে দেন একটি বাক্য। যাতে লেখা ছিল এমন- ‘সবাই এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করুন। এখানে বিনিয়োগ করলে শান্তি পাবেন।’
রাগীব আহসানকে গ্রেফতার করতেই অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে কুয়াকাটা হজুর নামে পরিচিত পটুয়াখালীর হাফিজুর রহমান সিদ্দিকের ওয়াজের একটি ভিডিও ক্লিপ। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায় ‘এহসান গ্রুপ গোটা জাতির জন্য রহমত’, ‘যারা আমাদের ভালোবাসেন তারা এহসান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না’, ‘এহসান গ্রুপকে যারা বিশ্বাস করবে না তারা মুনাফেক’।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, মসজিদের খাদেম ও ইমামদের টার্গেট করে তাদের মাধ্যমে টাকা টানছিল এহসান গ্রুপ। সেই ফাঁদে পড়ে তারা এখন প্রায় নিঃস্ব।
যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটি
২০১৪ সালের শেষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের টাকা আদায়ে গঠিত হয় ‘যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটি’। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন মফিজুল ইসলাম ইমন। এরপর এহসান গ্রুপে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তাদের তালিকা তৈরি করে টাকা ফেরতের চেষ্টা চালান তিনি।
মফিজুল ইসলাম ইমন দাবি করেন, এহসান গ্রুপে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ১৬ হাজারের বেশি গ্রাহক। সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা বিনিয়োগেরও রেকর্ড আছে যশোরে। টাকা বিনিয়োগ করে শুধু যশোরেই টাকার শোকে মারা গেছেন ৫৬ জন।
তবে ইমনসহ সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘ আট বছরে তাদের ‘সংগ্রাম কমিটি’ এহসান গ্রুপের দাপটে কিছুই করতে পারেনি। উল্টো তাদের নামেই মামলা দেওয়া হয়। এরপর ‘সংগ্রাম কমিটি’ ব্যাকফুটে চলে যায়।
এহসান গ্রুপে প্রায় ৩০০ কর্মী ছিল। তাদের কেউ কেউ বেতন পেতেন। আবার কেউ কেউ পেতেন না, এরা মাঠপর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী এনে দিলে বিনিয়োগের ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পেতেন। এভাবে দ্রুত গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে থাকে গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, রাগীব তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। তার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে শ্বশুর হন প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি, বাবা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাইয়ের মধ্যে গ্রেফতার আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক, বাকি দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য।
সার্বিক বিষয়ে পিরোজপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসুদুজ্জামান বলেন, এহসান গ্রুপের রাগীব ও তার ভাই বাশারকে র্যাবের কাছ থেকে তারা গ্রহণ করে পিরোজপুরে নিয়েছেন। ঢাকা থেকে ওই দুজন গ্রেফতার হলেও পিরোজপুরের পুলিশ গত ৯ সেপ্টেম্বর রাগীবের অপর দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খায়রুল ইসলামকে তাদের খলিশাখালী গ্রাম থেকে গ্রেফতার করে। তারা দুজনই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সদস্য। তাদের মধ্যে মাহমুদুল পিরোজপুর বাজার মসজিদের ইমামের দায়িত্বও পালন করছিলেন।
জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, ইমাম ও অন্যান্যদের টার্গেট করে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসানের বিরুদ্ধে সারাদেশে ১৫টির বেশি মামলা হয়। মামলাগুলোতে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় তিনি জামিন নেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী গ্রাহকদের বিরুদ্ধে তিনি উল্টো মামলাও করেন। এছাড়াও ২০১৯ সালের একটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেছেন।