করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ অবস্থা। দ্বিতীয় ঢেউয়ে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শনাক্ত-মৃত। বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের সঙ্গে দেশে রসদ জুগিয়েছে ইউকে, আফ্রিকা ও ব্রাজিলে শনাক্ত নতুন ভ্যারিয়েন্ট (করোনার নতুন ধরন)। প্রতিদিন সংক্রমণ শনাক্ত ও মৃতের রেকর্ড ভাঙছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ফলে হাসপাতালগুলোতে রোগীর সিটের চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারছেন না। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকটের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগীরা।
সংক্রমণ বেপরোয়া গতিতে ছড়িয়ে পড়ায় ভিড় জমছে হাসপাতালে। রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। রোগী ও স্বজনদের মধ্যে আইসিইউ নিয়ে হাহাকার। রাজধানীর ১০ হাসপাতালে ফাঁকা নেই আইসিইউ বেড। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নেই আইসিইউ বেড।
সিরাজগঞ্জের ১০০ শয্যার হাসপাতালে নেই আইসিইউর ব্যবস্থা।এটা শুধু সিরাজগঞ্জ কিংবা নাটোর নয়, দেশের প্রায় ৩৬টি জেলায় নেই আইসিইউর ব্যবস্থা। জীবন বাঁচাতে সংকটাপন্ন রোগীদের ঢাকায় রেফার্ড করা হয় জেলা শহর থেকে। ঢাকায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় এমনিতেই রোগীর চাপ বেশি। তার ওপর বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে সংকটাপন্ন রোগী। রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর জন্য হাহাকার। বেসরকারি হাসপাতালেও মিলছে না আইসিইউ। আইসিইউ না থাকায় হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে রাখা হচ্ছে রোগীদের। আইসিইউর ব্যবস্থা না হওয়ায় মারা যাচ্ছেন রোগী। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে করোনায় মৃতের তালিকা। আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় রোগী নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হচ্ছে স্বজনদের। তবু মিলছে না আইসিইউ।
এ বেপারে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে চারটি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। কিন্তু সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা না থাকায় শয্যাগুলো চালু করা যাচ্ছে না।’
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বাসিন্দা চন্দ্রনাথ প্রামাণিক তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে হৃদরোগে ভুগছেন। গত সপ্তাহে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তার করোনা পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। রিপোর্টে করোনা পজিটিভ আসে। এর মধ্যে দেখা দেয় তীব্র শ্বাসকষ্ট। তার ছেলে সজল প্রামাণিক বলেন, ‘বাবার আগে থেকে হৃদরোগ ছিল। করোনা টেস্টের রিপোর্ট আসার আগেই তার ভীষণ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চিকিৎসক জানান তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে। সিরাজগঞ্জে জেলা সদর হাসপাতালে যোগাযোগ করলে তারা জানান সেখানে আইসিইউ নেই। বেসরকারি হাসপাতালেও করোনা আক্রান্তদের আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। ঢাকায় যোগাযোগ করলে জানতে পারি সেখানে সাধারণ শয্যা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, আইসিইউ কোথাও ফাঁকা নেই। অবশেষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরে মেডিকেল কলেজ থাকলে সেখানে আইসিইউ রয়েছে। এ ছাড়া জেলা শহরের ১০০ শয্যার হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় রূপান্তরিত করে আইসিইউর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে কিছু জেলায় এখনো আইসিইউ শয্যা চালু করা সম্ভব হয়নি।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন মরিয়ম বেগম (৬১)। হঠাৎ রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হলে আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন বলে জানান চিকিৎসকরা।
অন্যদিকে, মরিয়ম বেগম নামক একজন অসুস্থ রোগীর ছেলে সৈকত হায়দার বলেন, ‘আইসিইউর জন্য সরকারি সব হাসপাতালে যোগাযোগ করেছি কোনোটাতেই আইসিইউ শয্যা মেলেনি। বেসরকারিতেও আইসিইউ পাওয়া যাচ্ছে না। এমপি, মন্ত্রীকে দিয়ে ফোন করিয়ে আইসিইউর ব্যবস্থা করানোর পরিস্থিতি আমাদের নেই। পরে এ হাসপাতালেই হাই ফ্লো অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে মাকে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরসূত্রে জানা যায়, সারা দেশে সাধারণ শয্যা রয়েছে ১০ হাজার ৭০৮টি। এর মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ৫ হাজার ১১২টি। আইসিইউ রয়েছে ৮২৫টি, ফাঁকা রয়েছে ১৭৩টি। রাজধানীতে কতগুলো আইসিইউ ফাঁকা রয়েছে তা প্রতিদিন জানাত স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু গতকাল সে তথ্য দেননি তারা। সে জায়গায় বলা হয়েছে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সমতুল্য শয্যা ফাঁকা রয়েছে ১৪৮টি। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যার ওপরও চাপ বাড়ছে। কুর্মিটোলা হাসপাতালে ২৭৫ শয্যার ধারণক্ষমতায় ১০৫ জন রোগী বেশি ভর্তি আছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই।
এ ব্যাপারে কভিড-১৯-বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম জানান, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। গত বছরও হাসপাতালে আইসিইউ সংকট ছিল, এ বছরও আছে। ২৮ জেলায় আইসিইউ আছে ৩৬ জেলায় নেই। এ জেলার রোগীরা বাঁচার আশায় ঢাকায় আসছেন। ঢাকায় তো সংক্রমণ বেশি, আগে থেকেই সংকট আছে। রোগীরা এত পথ পাড়ি দিয়ে এসে দেখছেন আইসিইউ নেই। আইসিইউ সংকটে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে, বাড়ছে মৃত্যু। সময় গেলেও আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।’