দেশীয় ই-কমার্সে বড় ধরনের চমক দেখিয়েছে ইভ্যালি। বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের আকর্ষণ দিয়ে ক্রেতা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে সফল হলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন গ্রাহক ভোগান্তির শীর্ষে অবস্থান করছে। ফলে ই-কমার্সে আস্থা হারাচ্ছে গ্রাহকরা। নানা ধরনের মন্তব্য করে পোস্ট দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবুও যেন কোনও বিকার নেই ইভ্যালির।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য ক্রেতার অভিযোগ, অর্ডার দেওয়া পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে তো দূরে থাক, দীর্ঘদিনেও মেলে না। প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযোগ করে কোনও লাভ হয় না। ফোন না ধরার অভিযোগও এন্তার। ক্যাশব্যাক দীর্ঘদিন কোম্পানির (ইভ্যালি) হিসাবে পড়ে থাকলেও জটিল নিয়মের কারণে গ্রাহক তা ক্যাশ (নগদায়ন) করাতে পারে না। ক্যাশব্যাক অফারের সঙ্গে আরও টাকা যোগ করে তবেই সে টাকা দিয়ে নতুন করে পণ্য কিনতে হয়।
ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভ্যালির আগ্রাসী ব্যবসায়িক মডেলের কারণে দেশি অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ইভ্যালি যে পরিমাণ ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করে, তা দেশীয় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় তারা প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। ইভ্যালিতে গিয়ে ক্রেতারাও বিভিন্ন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তারা তাদের ই-কমার্সকে ছোট পরিসরে টিকিয়ে রেখেছেন। উদ্যোক্তাদের ভাষ্য, এই ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগিতা শেষ হলে আবারও সক্রিয়ভাবে তারা ই-কমার্সে ফিরবেন। অন্যদিকে টিকতে না পেরে ১৫-২০টি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, চালুর আগে দেশে ই-কমার্সের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল। ইভ্যালি এসে সেই পরিবেশ নষ্ট করে ই-কমার্স বাজার ধ্বংস করেছে।
এদিকে দেশে ই-কমার্স দেখভালের কোনও কর্তৃপক্ষ নেই। ই-কমার্সভিত্তিক সংগঠন ই-ক্যাব সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেউ পণ্য কিনে প্রতারিত হলে বা অভিযোগ দিলে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে মীমাংসা করে। অন্যদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর থাকলেও ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণ ও দেখভালের জন্য তা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে ও প্রতিকার পেতে ই-কমার্স বিষয়ক আইনের বিধান থাকার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেছেন, এই আইন থাকলেই ক্রেতাদের মধ্যে এটি নিয়ে আস্থা তৈরি হবে। কোনও ই-কমার্স আগ্রাসী হতে পারবে না, সবাইকে আইন মেনে ব্যবসা করতে হবে।
ই-কমার্স খাতে আগ্রাসী ব্যবসায়িক নীতি, বাজার ধ্বংস, অন্যদের বাজারে টিকতে না দেওয়া, বিদেশি ই-কমার্সকে এ দেশে আসতে উৎসাহ দেওয়া, গ্রাহক ভোগান্তি ইত্যাদি বিষয়ে শতেক অভিযোগ ইভ্যালির বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হয় ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুরুতে ছোট পরিসরে পরে বড় একটি বাজার ধরতে ইভ্যালি ক্যাশব্যাক বা ভাউচারের মতো মার্কেটিংয়ে যায়। আলোড়ন তৈরি করতে পারে এমন একটি ক্যাম্পেইন না হলে ইভ্যালি কখনও এত দ্রুত সময়ে এই পরিমাণ গ্রাহক পেতো না, বাজারের একটি বড় অংশ দখল করতে পারতো না। ইভ্যালির বিপণন প্রক্রিয়া দেশের সব আইন মেনে করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টার্টআপ বা ই-কমার্সের মার্কেটিং ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও এমন মার্কেটিং দেখা যাবে। এখন এই ধরনের মার্কেটিংকে দেশের কোনও আইনে ‘আগ্রাসী’ বলা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, মার্কেটে দ্রুত নিজেদের একটি অবস্থান দখলের জন্য আইনের মধ্য থেকে যে উপায়ে বিপণন করা যায় আমরা সেটি করেছি। তিনি বলেন, আমাদের গ্রাহক সংখ্যা বাড়ার ফলে অফারের পরিমাণ কিন্তু আমরা কমিয়ে আনছি। তিনি উল্লেখ করেন, আগে ৩০০ শতাংশ ভাউচার দেওয়া হতো। এটা আরও দীর্ঘদিন আগে বন্ধ করা হয়েছে। এরপর ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দেওয়া হতো, সেটিও বন্ধ করা হয়েছে। এখন কোনও পণ্যে মূল্যছাড় থাকলে সেটিও তুলনামূলক কম পরিমাণে থাকে। তিনি জানান, শুরুর দিকে সর্বোচ্চ ১০০ বা ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক দেওয়া হতো। এখন এটাও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আমরা যা খরচ করছি সেটা গ্রাহক তৈরিতে, এটা আমাদের এক ধরনের বিনিয়োগ।
গ্রাহকের পণ্য ডেলিভারিতে দেরির বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ রাসেল বলেন, অনেক সময়েই পণ্য ডেলিভারি করতে দেরি হচ্ছে। এটা আমরা মেনে নিচ্ছি। এর জন্য গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। তিনি উল্লেখ করেন, বাস্তবতা হচ্ছে, একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক পণ্য প্রসেসিং করতে কখনও কখনও এমনটা হয়। তার দাবি, ইভ্যালিতে যে পরিমাণ অর্ডার আসে তার তুলনায় এধরনের সমস্যা এক শতাংশেরও কম, শূন্য দশমিক ১। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে বড় পরিসরের ভৌত অবকাঠামো এবং প্রচুর লোকবল দরকার। আগামী ৫ মাসে লোকবলের সংখ্যা অন্তত চারগুণ বাড়াবো আমরা।
ইভ্যালির কর্মকাণ্ডের কারণে ই-কমার্সে গ্রাহকরা আস্থা হারাচ্ছে—এ বিষয়ে ইভ্যালির অবস্থান জানতে চাইলে ইভ্যালি কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কাছে এমনটা মনে হচ্ছে না। কিছু জায়গায় সমস্যা হচ্ছে কিন্তু তাতে পুরো ইন্ডাস্ট্রির ওপর থেকে গ্রাহকরা আস্থা হারাচ্ছে এমন না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-কমার্সে নতুন গ্রাহক আসছে। আগের চেয়ে বেশি অর্ডার পড়ছে। আস্থা যদি না থাকতো তাহলে এমনটা হতো না। অন্যদিকে করোনাকালে ই-কমার্সগুলো নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়েছে, সে বিষয়টিও বিবেচনা করবেন গ্রাহকরা।