।। নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে লাগাতারভাবে চালের দাম বাড়ার পর এখন আবার কিছুটা কমেছে। এই সময় দেশে কোনো বন্যা, খরা, রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও নিত্য প্রয়োজনীয় এই খাদ্য দ্রব্যটির দাম প্রতি কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এখন পাইকারিভাবে প্রতি বস্তায় দাম কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে তার সুফল এসে পৌঁছায়নি। এতে বিপাকে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। খবর দ্য ডেইলি স্টার।
মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি বাজারে গিয়ে একাধিক চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনের সময় পর্যন্ত মানভেদে মিনিকেট চাল তারা বিক্রি করেছেন কেজি প্রতি ৪৮ থেকে ৪৯ টাকায়। এর পর এক সপ্তাহের মধ্যে দাম বেড়ে ৫৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে। অপেক্ষাকৃত মোটা ব্রি-২৮ চালের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪১ টাকা। এই চালের দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় পাঁচ টাকা। গত দুই দিনে দুই প্রকার চালের দামই কেজিতে এক থেকে দেড় টাকা কমেছে।
অথচ রাজধানীর শ্যাওড়াপাড়া বাজারে আজ বুধবার মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা কেজি দরে। আর ব্রি-২৮ ছিল কেজি প্রতি ৪৫ টাকা। অর্থাৎ পাইকারি বাজারে কিছুটা দাম কমলেও খুচরা বাজারে এখনও এর তেমন প্রভাব পড়েনি।
অন্যদিকে কেজি প্রতি নাজিরশাইল চালের দাম ছিল মানভেদে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ও সুগন্ধি আতপ চালের দাম ছিল ৯০ টাকা। এই দুই প্রকারের চালের দাম বাড়েনি। এই চাল সাধারণত উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের রান্নাঘরে যায়। ফলে বাড়তি দামের কষাঘাত সহ্য করতে হচ্ছে শুধু নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষকেই।
জানা যায়, ভারতের খুচরা বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। কলকাতার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে প্রকারভেদে মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৬ থেকে ৪২ রুপি কেজি দরে যা বাংলাদেশি টাকায় ৪২ থেকে ৪৯ টাকার মধ্যে। সেখানে মোটা আতপ ও সেদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৩ থেকে ৩৫ টাকায়। আর বাংলাদেশে যেটা চিনিগুড়া হিসেবে পরিচিত সেই চাল মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৭ টাকায়। গত কয়েক মাসে সেখানে চালের দাম বাড়েনি।
রাজধানীর চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল গেট থেকেই বেশি দামে তাদের চাল কিনতে হচ্ছে। তাই বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া তাদের উপায় নেই। এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু মিল মালিকদের দায়ী করছেন তারা। আর মিল মালিকরা বলছেন, নির্বাচনের পর ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের দাম বাড়াতে হয়েছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের সময় পরিবহন সংকট ছিল। এখন বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসায় তারাও দাম কমিয়েছেন। এখন ক্রেতা পর্যায়ে চালের বাড়তি দামের জন্য পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের দায়ী করছেন তারা।
যে অজুহাতেই হোক, দাম যে হারে বেড়েছে, সেই হারে কমেনি। ফলে চালের বাজার সহসা আগের অবস্থায় ফিরছে না।
চালের দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করছেন কনজিউমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “এই সময় চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এর পেছনে কারও না কারও কারসাজি রয়েছে। সরকার এদের খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলেই পরিস্থিতি আগের অবস্থায় চলে আসবে।”
সরকারের প্রতি তার পরামর্শ, চালের সংকট না থাকায় এখনই চাল আমদানি উৎসাহিত করতে আমদানি শুল্ক কমানো ঠিক হবে না। কারণ যারা বাজারে কারসাজি করছে তারাই অপেক্ষায় রয়েছে এই সুযোগ নেওয়ার জন্য। তার আশঙ্কা, কম শুল্কে বিদেশি চাল দেশের বাজারে ঢুকলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
গোলাম রহমান আরও বলেন, “এই সরকারের আগের আমলেও এভাবে বাজারে কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ঢাকা-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, দায়ীদের খুঁজে বের করে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায় না। যারা অপকর্ম করে তাদের যদি বার বার ছাড় দেওয়া হয় তাহলে এই ঘটনা বার বার ঘটবে।”
এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে বাণিজ্যমন্ত্রীকে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস করা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে চাল ব্যবসায়ীরাই জানালেন, দেশের বাজারে এখন যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তার প্রায় পুরোটাই দেশের ভেতরেই উৎপাদন করা। ভারত বা পার্শ্ববর্তী অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি করা চালের প্রভাব বাজারে এখন নেই বললেই চলে।
বেনাপোল স্থলবন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। দেশের বাজারে চালের চালের সংকটের সময় দৈনিক ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টন পর্যন্ত চাল আমদানি হয়। ফলে চাল আমদানির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সেখানেও চালের সংকটের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে নওগাঁর মেসার্স তছিরন অটো রাইস মিলের মালিকদের একজন মামুনুর রশিদ মিলন এই প্রতিবেদককে বলেন, “দেখুন গত বছর ডিসেম্বর মাসের সঙ্গে এবছরের ডিসেম্বর মাসের ধানের বাজার তুলনা করলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। গত বছর এই সময়টায় মানভেদে ধানের দাম মণপ্রতি ছিল ৯০০ থেকে ১,০০০ টাকা। অথচ এবার ডিসেম্বরে কৃষকরা ধান বিক্রি করেছেন ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। এখন নির্বাচনের পর ধানের দাম কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় চালের দামেও প্রভাব পড়েছে।” তার দাবি, দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে উৎপাদনকারী কৃষকরাই লাভবান হচ্ছেন। এর পেছনে মিল মালিকদের কোনো কারসাজি নেই।
অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর এক চাল ব্যবসায়ী জানান, মিল মালিকরা ধাপে ধাপে দাম বাড়িয়েছে এবার। এমনকি বাজার অস্থির থাকার অজুহাত দেখিয়ে বিক্রি বন্ধ করে রাখেন তারা। এর পর কিছুদিন বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা বেশি দামে চাল বিক্রির পর এখন আবার বস্তায় ৫০ টাকা কমিয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা। এতে ব্যবসায়িক ঝুঁকিতে রয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে করছেন না তিনি।