করোনার মাঝে ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে ডেঙ্গু

নিজস্ব প্রতিবেদক : বছর ঘুরে আবারও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অন্তত ১৭ জন ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে শুধু ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১০৫ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর সারাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১১৪ জন রোগী।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বৃষ্টির সঙ্গে বাড়তি আর্দ্রতা; এমন আবহাওয়া এডিস মশা বিস্তারের জন্য সহায়ক। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ছে মশার বিস্তার। আর
মশা বাড়লে সাধারণ ভাবেই রোগী সংখ্যা বাড়বে। তাই মহামারী রূপ নেওয়ার আগেই মশক নিয়ন্ত্রণে আরো সচেষ্ট হওয়ার তাগিদ তাদের।

#ডেঙ্গুর জ্বরের সময়কাল

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল আরো এগিয়ে এসেছে।

তিনি বলেন, এই সময়ে প্রায় বৃষ্টি হয় ফলে, ফুলের টব, পরিত্যক্ত ক্যান, টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট এই রকম পরিত্যক্ত যেকোনো জিনিসের মধ্যে অল্প অল্প বৃষ্টির পানি বিক্ষিপ্তভাবে জমে যাবে। মুলত এসবে এডিস মশার বিস্তার ঘটে।

# এডিস মশা কখন কামড়ায়

ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা। এই মশা কখনও অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে।

# ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

হঠাৎ করে জ্বর। শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি-১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। গলা ব্যথা, চরম অবসন্নতা এবং বিষাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে।

অরুচি, বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে। রোগীর চোখ লাল হতে পারে এবং ত্বকও লাল হতে পারে।

জ্বর ৩-৭ দিন স্থায়ী হয়। শরীরের চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হয়।

সাধারণত জ্বর শুরু হওয়ার ৩-৪ দিন পর থেকে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ জনিত উপসর্গ দেখা যায় ত্বকে।

 

# ডেঙ্গু জ্বর কাদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ

আক্রান্ত হতে পারেন যে কোন বয়সের মানুষ। তবে নবজাতক,, স্থূল স্বাস্থ্যের অধিকারী, গর্ভবতী নারী, ঋতুবতী নারী, পেপটিক আলসার, থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রক্তরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি,
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগী, দীর্ঘমেয়াদে যকৃৎ ও কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি, দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড ও ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহারকারী এই রোগের নানা জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

# কী লক্ষণ দেখলে হাসপাতালে যেতে হবে

জ্বর কমার প্রথম দিন রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি। বার বার বমি/ মুখে তরল খাবার খেতে না পারা।

পেটে তীব্র ব্যথা। শরীর মুখ বেশি দুর্বল অথবা নিস্তেজ হয়ে পড়া/হঠাৎ করে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া

শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া/শরীর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।

# প্রতিকার ও করনীয়

ঘুমানোর সময় বিশেষত বিকেল ও রাতে মশারি খাটিয়ে ঘুমানো। মশা যাতে কামড়াতে না পারে সে জন্য গায়ে ও পরার কাপড়ে মশক নিবারক ক্রিমের ব্যবহার কিংবা প্রয়োজনে লম্বা হাতওয়ালা শার্ট ও ফুলপ্যান্টসহ মোজা পরিধান,
প্রয়োজনে বাড়িতে মশার প্রবেশ নিয়ন্ত্রণকল্পে বাড়ির সব জানালা, ভেন্টিলেটর মশা অনভিগম্য জালক বা স্ক্রিনের ব্যবহার।

গৃহস্থালির আশপাশে পড়ে থাকা পানি জমার বিভিন্ন আধার যেমন- টিনের ক্যান, পরিত্যক্ত টায়ার, অব্যবহৃত পানির পাত্র, সেপটিক ট্যাংক, এয়ারকুলার প্রভৃতিতে যাতে পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। প্রয়োজনে উপরোক্ত আবর্জনাগুলো অপসারণের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রয়োজনে পানির ট্যাংক, হাউজ কিংবা ম্যানহোলের গর্তগুলো উপযুক্ত মশক অনভিগম্য ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যাতে পানির আধারের পানিগুলো এডিস মশার বংশবিস্তারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে।

ফুলের টব বা ফুলদানিতে জমে থাকা পানি প্রতি তিন দিন অন্তর ফেলে দিতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপজঙ্গল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।

# ডেঙ্গু রোগীর যত্ন

তরল জাতীয় খাবার খাওয়া উচিৎ। যেমন- পরিষ্কার জল, আখের রস, ORS, ডাবের জল, লেবুর জল, গ্রীন টি, কমলালেবুর রস ইত্যাদি।

দুধ জাতীয় ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিৎ নিরামিষাশীদের জন্য শাকসবজি ও ফল খাওয়া দরকার তেল মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।

সঠিক পরিমাণ প্রোটিন খান। মাছ, মাংস, ডিম এবং সয়াবিন, চিজ,পনির জাতীয় খাবার খান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৯৩ জন। এর পরের দুই বছর যথাক্রমে ৪৪ ও ৫৮ জন মারা যান। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর ডেঙ্গুতে কেউ মারা যাননি।

এরপর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এর আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়ায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। তবে সে বছর সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭৯।

২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। সে বছর ১ হাজার ৪০৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। ডেঙ্গু সন্দেহে ১২ জনের মৃত্যুর তথ্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ডেঙ্গুর কারণে ৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আর ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানি ঘটেছে ১০৫ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি সংখ্যা ৯৫৯ জন।

এসএম