স্বাস্থ্য ডেস্ক: মাতৃকালীন সময়ে নারীদের বিশেষ চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হয়। এ সময় গর্ভের শিশু ও মায়ের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। এজন্য ডাক্তারের সাথে যোগাযোগসহ হাসপাতালে যাওয়া খুব জরুরী। কিন্তু দেশে করোনাভাইরাসের মহামারীর জন্য গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার বিষয়টিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
দেশের সর্বত্র যানবাহন চলাচল সীমিত রয়েছে। তাই সঠিক সময়ে গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসা সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। তার ওপর হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে তারা বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। এসব কারণে গর্ভবতী মা ও তার শিশু উভয়ে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে এ বছর শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়তে পারে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার ২০০ নারী গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং সন্তান জন্মের পর সৃষ্ট জটিলতায় মৃত্যু হয়। এর অধিকাংশ মায়েরই মৃত্যু ঘটে কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে সন্তান প্রসবের সময়। এছাড়া গর্ভধারণকালে নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে গিয়ে মাতৃত্বকালীন সেবা না নেওয়ার কারণেও অনেক মায়ের মৃত্যু হয়। তাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়াতে এবং সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান জন্মের জন্য বিশেষজ্ঞের নির্দেশ হচ্ছে, গর্ভধারণকালে মাকে কম করে হলেও চার বার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এছাড়া সন্তান জন্মের পরও অন্তত চার বার চিকিৎসকের কাছে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে গর্ভবতী মায়েরা উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে পারছেন না। পুরনো ঢাকার তরুণ ব্যবসায়ী মাহবুব হাসান বলেন, ‘আমার স্ত্রী এখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ সময় চিকিৎসকের কাছে যাওয়া দরকার পড়ে নানা কারণেই। কিছুদিন আগে ডাক্তার বলেছিলেন একটা আল্ট্রাসনো করালে ভালো হত। খোঁজ নিয়ে জানলাম, হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু করোনার ভয়ে পরিবারের অন্যরা যেতে দিতে রাজী হয়নি। এখন কী করব, বুঝতে পারছি না। এই পরিস্থিতি তো অল্প কয়েক দিনে মিটে যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’
সদ্যই সন্তানের পিতা হওয়া কবির হোসেন বলেন, ‘গত ৮ এপ্রিল আমি কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছি। খুবই ভালো লাগছে। কিন্তু করোনার কারণে শিশু ডেলিভারির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে বড় বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। কমলাপুরে আমাদের বাসা। আমার স্ত্রীর ডেলিভারি ডেট আরও পরে ছিল। কিন্তু হঠাৎই তার ব্যথা উঠলে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা নিজেরাই বাচ্চা জন্মদানের দায়িত্ব নেয়ার কথা প্রস্তাব করে। সেরকম শঙ্কা বিবেচনা করে আমাদের একজন আত্মীয়কে আগেই বাসায় এনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি ভরসা পাইনি। তাই এলাকারই একটি বেসরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করে ওকে নিয়ে যাই। সব ঠিকঠাক ঘটেছে এজন্য আল্লাহকে শুকরিয়া জানাই। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আমরা মা, বাবা ও মেয়ে একপ্রকার কোয়ারেন্টিনেই আছে। বাড়ির বয়স্কদের আমাদের ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না। নিজেরাও বের হচ্ছি না। খুব সমস্যায় পড়ে গেছি।’
তিনি আরও জানান, ‘ডেলিভারির সময় নানা ধরণের ওষুধপত্রের দরকার ছিল। সেগুলো কিনতে গিয়ে পুলিশের ধাওয়া পর্যন্ত খেতে হয়। পুলিশ কোন বাছ বিচার ছাড়াই, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই রাস্তায় থাকা মানুষের ওপর লাঠিপেটা করে। আমি তখন এক দৌড়ে ফার্মেসির সামনে গিয়ে দাঁড়াই এবং মারের হাত থেকে বেঁচে যাই। এটা খুবই খারাপ পরিস্থিতি। মনে হয়, এই পরিস্থিতির কারণে অনেক মা ঠিকঠাক সেবা পাবেন না এবং সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভকালীন ও প্রসবের সময় এবং সন্তান জন্মের প্রথম সপ্তাহে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হলে তা প্রতিরোধযোগ্য নবজাতকের মৃত্যু ও গর্ভে শিশুর মৃত্যু রোধে বড় ভূমিকা রাখে। মা ও নবজাতকের সেবার জন্য দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী যে কোনো সময় পাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সম্পন্ন স্পেশাল কেয়ার ইউনিট সেবা নিশ্চিত করা গেলে মা ও নবজাতকের মৃত্যু কমানো সম্ভব। সরকার যেন এক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেয় তার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নবজাতকের মৃত্যু ঘটা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতিবছর জন্মের পর এদেশে ৬২ হাজার নবজাতক মারা যায়। করোনায় স্বাস্থ্যসেবা সংকট সৃষ্টি হওয়ায় এ বছর শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়তে পারে। সরকারের উচিৎ বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে, গর্ভবতী মা ও শিশুর জরুরী স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চয়তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য আলাদাভাবে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবাসহ বিশেষায়িত হাসপাতালের ব্যবস্থা করা।