করোনার মধ্যেও ২৪ ঘণ্টা কাস্টমস হাউস, বিমানবন্দর ও শুল্ক স্টেশনে সেবা দিচ্ছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে অভিযোগহীন সেবা দিয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন এনবিআরের এসব বিভাগের কর্মকর্তারা। করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত ‘চলাচল নিষেধাজ্ঞা’র মধ্যেও আমদানি-রফতানি সচল রাখতে একইভাবে সেবা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে মেডিসিন ও অন্যান্য শিল্পের ভ্যাট আদায়, হোটেল-রেস্তোরাঁ মনিটরিংসহ রফতানির উত্সাহে মাঠে জরুরি সেবা দিচ্ছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। অনলাইন রিটার্ন নেওয়াও বিশাল কর্মযজ্ঞ। করোনায় জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে উন্নয়নের অক্সিজেন রাজস্ব আহরণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন সময় প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এরপরও সরকার ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে জরুরি সেবার তালিকা ও করেনার টীকা গ্রহণে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জরুরি সেবাদাতার তালিকায় এ দুই বিভাগের নাম নেই! এমনকি এনবিআরকে কপিও দেওয়া হয়নি।
তবে জনপ্রশাসনের জারি করা প্রজ্ঞাপনে জরুরি পরিষেবার তালিকায় কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের নাম কেন নেই— এ বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেনি এনবিআরের ঊধর্বতন কর্মকর্তারা। অনেক কর্মকর্তা এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এনবিআরের হিসাবে, করোনা আক্রান্ত হয়ে একজন কাস্টমস কমিশনারসহ ৯ জন কর্মকর্তা মারা গেছেন। তাদের সংস্পর্শে এসে পরিবারের বহু সদস্য মারা গেছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ১০ জনেরও অধিক। রাজস্ব আদায় আর সেবা দিতে গিয়ে করোনায় বিপর্যস্ত কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ।
এনবিআর সূত্রমতে, করোনার মধ্যেও আমদানি-রফতানি ও ভ্যাট আহরণ থেমে নেই। থেমে নেই রাজস্ব আহরণের গতি। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত (জুলাই-মার্চ) নয় মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ২৭ হাজার ৭৬৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা (সাময়িক)। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৮৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। গত অর্থ বছরের তুলনায় আহরণ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরমধ্যে কাস্টমস খাতে আদায় হয়েছে ৫৩ হাজার ৯৯৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ খাতে আহরণ প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা তিন বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া ভ্যাট খাতে আদায় হয়েছে ৬৭ হাজার ৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আয়কর খাতে আদায় হয়েছে ৫৫ হাজার ৮০৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
অপরদিকে, সর্বশেষ ৪ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সাতদিনের ‘চলাচল নিষেধাজ্ঞা’ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে জরুরি পরিষেবা হিসেবে ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন নিষেধাজ্ঞার আওতা বর্হিভূত থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু জরুরি সেবার তালিকায় কাস্টমস ও ভ্যাটের নাম নেই।
এছাড়া তারা আরও জানান, কাস্টমস হাউসে কর্মকর্তাদের আমদানিকারক-সিএন্ডএফ এজেন্টসহ অল্প জায়গায় শত শত লোকের মধ্যে সেবা প্রদান করতে হয়। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে মালামাল পরীক্ষণ করতে হয়। পণ্য খালাস সরেজমিনে তদারকি, প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম ও চোরাচালান দমন, রামেজিংয়ের জন্য গভীর সমুদ্রে বিদেশি জাহাজে গমন ও তল্লাশি করা, গেট ডিভিশন ঝুঁকিপূর্ণ কর্তব্য পালন এবং বন্দরের সঙ্গে সমন্বয় করে পণ্যের দ্রুত খালাস করতে হয়। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনায় বেশি আক্রান্ত হয়। এছাড়া বিমানবন্দরগুলোতে প্রতিদিন শত শত বিদেশি যাত্রী হ্যান্ডেলিং ও সুচারুভাবে পারাপার, যাত্রীসেবা দ্রুতকরণ, শুল্কযোগ্য পণ্য পরীক্ষণ ও শুল্কায়ন এবং চোরাচালন দমনে কাজ করতে হয়। এছাড়া বিমানবন্দরের শত শত জরুরি কার্গো ব্যবস্থাপনা করতে হয়। সকল ক্ষেত্রে মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়। এভাবে প্রচণ্ড ঝুঁকিতে কাজ করছে কাস্টমসের কর্মকর্তারা। রাজস্ব আহরণে জীবন বাজি রাখলেও জরুরি সেবার তালিকায় কাস্টমস বিভাগের নাম উল্লেখ নেই।
অপরদিকে ভ্যাট কমিশনাররা জানান, করোনার মধ্যেও দেশের সব ভ্যাট অফিস খোলা রয়েছে। অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিলসহ সব ধরনের ভ্যাট সেবা দেওয়া ও রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। করোনা ঝুঁকির মধ্যেও কর্মকর্তারা ভ্যাট রিটার্ন দাখিল ও মনিটরিং করতে ছুটছেন মার্কেট থেকে মার্কেটে। ভ্যাট নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল ও ভ্যাট জটিলতা নিরসনে কমিশনারেটগুলো ভ্যাট মেলা করছে। এতে সেবা দিয়ে গিয়ে করদাতাদের সংস্পর্শে এসে বহু কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাড়াতে কমিশনারেটগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এতে কোন কোন কমিশনারেট মাসে ৯৮ শতাংশ অনলাইন রিটার্ন দাখিল হচ্ছে।