।। আবহাওয়া ডেস্ক ।।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘এসা’)-র উপগ্রহ ‘কোপার্নিকাস সেন্টিনেল-৩’-র পাঠানো তথ্য ও ছবি এক দুঃসময়ের পূর্বাভাস দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড মেটিরিওলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও)-এর দেওয়া তথ্য বলছে, আর মাসখানেকের মধ্যেই খুব শক্তিশালী ‘এন নিনো’র সম্ভাবনা ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। ডিসেম্বর পড়তেই এল নিনো তৈরি হতে শুরু করেছে। এ মাসের শেষাশেষি তা নেবে পূর্ণাঙ্গ রূপ।
জোর আশঙ্কা, প্রশান্ত মহাসাগরের চিলি ও পেরু উপকূল এবং মহাসাগরের মধ্যাঞ্চলে তৈরি হওয়া সেই ‘এল নিনো’র জেরে এবার ওলটপালট হয়ে যেতে পারে ভারতে বর্ষার মওসুম। উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। হতে পারে ভয়াবহ খরা। যার অনিবার্য প্রভাব পড়বে কৃষিতে। এতে দারুণভাবে মার খেতে পারে ফসল উৎপাদন।
ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও আছে একই আশঙ্কায়। তবে শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয় এই ভয়ঙ্কর ‘এন নিনো’র জন্য চিলি, পেরু-সহ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ও পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটতে পারে প্রচণ্ড খরা, একের পর এক দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাও। খবর আনন্দবাজার।
দিল্লিতে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের স্যাটেলাইট মেটিরিওলজি ডিভিশনের প্রজেক্ট ডিরেক্টর অসীম কুমার মিত্র জানিয়েছেন, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পাঠানো ওই উপগ্রহে যে সর্বাধুনিক যন্ত্রগুলি রয়েছে, তাতে অন্তত ৯০ শতাংশ পূর্বাভাস মিলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য এও জানিয়েছেন, এখনই বলা যাচ্ছে না, এবারের এল নিনো কতটা ভয়াবহ হবে। তার জন্য ফেব্রুয়ারি, মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই এল নিনো যদি মার্চ, এপ্রিলের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, তা হলে তার ততটা প্রভাব পড়বে না ভারতের বর্ষাকালের উপর। তবে যদি তার মেয়াদ বাড়ে, তা হলে তা যথেষ্টই উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ভারত ও এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য।
তবে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই টের পেয়েছেন, চিলি, পেরু-সহ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলের জলস্তরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এ মাসের শেষে তা আরও বাড়বে। এল নিনোর ঘটনা মূলত ঘটে চিলি, পেরু-সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী দেশগুলিতে। মোটামুটি ভাবে ২ থেকে ৭ বছর অন্তর। সেই সময় মহাসাগরের জলস্তরের (সি সারফেস) তাপমাত্রা অন্তত ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। ফলে উপকূলবর্তী এলাকার বায়ুমণ্ডলও তেতে ওঠে।
ওই সময় মহাসাগরের পিঠের (সি সারফেস) জল দ্রুত হারে অসম্ভব গরম হয়ে যায়। কারণ, ওই সময় প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে গরম জলের স্রোত ধেয়ে আসে মহাসাগরের পূর্ব দিকে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তের জলস্তর অনেকটাই গরম। তুলনায় ঠান্ডা চিলি, পেরু-সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী জলস্তর।
এল নিনোর সময় পূর্ব উপকূলের সেই গরম জল তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় মহাসাগর সংলগ্ন স্থলভাগের বিভিন্ন দেশের বহু এলাকার। ওই সময় সমুদ্রের তলদেশ থেকে ঠান্ডা জলও উপরে উঠে আসতে পারে না। ফলে সেখানকার সমুদ্রের পিঠের জলস্তর ঠান্ডা হওয়ার সুযোগই পায় না। এই অবস্থা চলে প্রায় এক বছর। তার পর শুরু হয় ‘লা নিনা’। যার জেরে সমুদ্রের জল দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করে, পূর্ব প্রান্তে। কারণ, এল নিনোর সুবাদে গরম হয়ে ওঠা মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তের জলস্তর আবার পশ্চিম দিকে বইতে শুরু করে।
এই ধরনের ভয়াবহ ‘এল নিনো’র জন্য এই শতাব্দীতে এর আগে ভারতকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল, তিন বছর আগে, ২০১৫ সালে। প্রচণ্ড খরায় শুকিয়ে গিয়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু এলাকা। সে বছর সারা দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। ভারতের বর্ষার মরসুমে ততটা প্রভাব না ফেললেও, ২০০৯ সালের ‘এল নিনো’ও শক্তির দাঁড়িপাল্লায় ছিল যথেষ্টই ভয়াবহ। একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭২, ১৯৮২, ১৯৮৩ সালে। ওই বছরগুলিতেও পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে জন্মানো ‘এল নিনো’ বড়সড় প্রভাব ফেলেছিল ভারতের বর্যার মরশুমে। তবে ১৯৯৭, ২০০২ ও ২০০৪ সালের ‘এল নিনো’র ততটা প্রভাব পড়েনি এ দেশে। আর ’৯২ সালের এল নিনোর দুঃসহ প্রভাব এখনও ভারতীয়রা সম্ভবত ভুলতে পারেননি।
তবে ভারতে এল নিনোর প্রভাবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দেখা গেছে পরের বছর লা নিনোর প্রভাবই বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি এ বছর খরা থেকে মুক্তি পায়ও, পরের বছর অতি বন্যার আশঙ্কা সেক্ষেত্রে অনেক বেশি। অর্থাৎ খরা বা বন্যা, বাংলাদেশকে কোনো একটির মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
।