ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: চালের দাম নিয়ে অস্বস্তি না কাটতেই ভাবনা বাড়াচ্ছে গম। বিশ্বের গম রপ্তানিকারক অন্যতম দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। বর্তমানে যুদ্ধলিপ্ত দুই দেশ থেকে রপ্তানি বন্ধ থাকার প্রভাব টের পাচ্ছে বাংলাদেশও। বিশেষ করে ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারেও পড়ছে বাড়তি চাপ। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় না থাকলেও} তাই বাজারে প্রভাব পড়ছে ঠিকই। দেশে ভোগ্যপণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ভারতের ঘোষণার পরপরই দাম বেড়েছে প্রতি মণে একশ টাকারও বেশি। যার প্রভাবে দাম বেড়েছে আটা, ময়দা, পাউরুটিসহ এজাতীয় খাদ্যপণ্যের।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভারত গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর দেশের বড় গম আমদানিকারক ও সরবরাহকারী শিল্প গ্রুপ আগে বিক্রিত ডিও’র (ডেলিভারি অর্ডার) গম সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ভোজ্যতেলের পর গমের দাম বাড়ায় প্রক্রিয়াজাত খাবার শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।
ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) শুক্রবার জানায়, নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা গম রপ্তানিতে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয় এ নিষেধাজ্ঞা। তবে ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, যেসব রপ্তানি চালানের ঋণপত্র (এলসি) বিজ্ঞপ্তির আগেই ইস্যু করা হয়েছে, সেগুলো যেতে পারবে।
অন্যদিকে, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেডের ওই ঘোষণার পর ১৫ মে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ করবে না ভারত। ভারতে গম রপ্তানির ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ এরই মধ্যে চুক্তিবদ্ধ চালানের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ নির্দেশাবলি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও গম রপ্তানি আটকাবে না।
রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত সাম্প্রতিক হলেও গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি (২০২১-২২) অর্থবছর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানি কমেছে।
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ১০ মাসে (১ জুলাই ১৫ মে পর্যন্ত) সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৯০ মেট্রিন টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৯ লাখ ৮২ হাজার ৭০০ টন চাল এবং ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন গম। একই সময়ে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন। এতে চাল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪০ মেট্রিক টন এবং গম আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন। গত ২০ মার্চের পর থেকে সরকারিভাবে কোনো গম আমদানি হয়নি। সবমিলিয়ে ১৫ মে পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে খাদ্য মজুত রয়েছে ১১ লাখ ২৮ হাজার ৯০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১০ লাখ ১৫ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন এবং গম মজুত রয়েছে মাত্র ১ লাখ ১২ হাজার ১৯০ মেট্রিক টন।
অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে (২০২১ সালের ১৫ মে) সরকারিভাবে খাদ্যশস্যের মজুত ছিল বর্তমানের প্রায় অর্ধেক। কিন্তু তাতেও গমের মজুত ছিল বর্তমানের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। ওই সময় খাদ্য মজুত ছিল ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন। এতে গমের মজুত ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন এবং চালের মজুত ছিল ৩ লাখ ৬২ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত সাড়ে ১০ মাসে খাদ্য অধিদপ্তর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৩২ টন গম আমদানি করেছে। একই সময়ে বেসরকারি আমদানিকারকরা ১৩ লাখ ৭২ হাজার ২৬৮ টন গম খালাস নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এর মধ্যে গত ১ এপ্রিল থেকে সবশেষ দেড় মাসে সরকারি পর্যায়ে কোনো গম না এলেও বেসরকারি আমদানিকারকরা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭৯ টন শুল্কায়ন করেছে। গত দেড় মাসে বেসরকারি চারটি প্রতিষ্ঠান এসব গম আমদানি করেছে বলে চট্টগ্রাম কাস্টম সূত্রে জানা যায়।
এর মধ্যে আজমেরি ফ্লাওয়ার অ্যান্ড অয়েল মিল ৬ হাজার ৬০০ টন, বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ৭৫ হাজার ৬২৯ টন, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিল ৭৩ হাজার ৪৫০ টন এবং রুবি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ৩৩ হাজার টন গম বন্দর থেকে খালাস নিয়েছে। তাছাড়া গত ৯ মে ভারত থেকে ৩২ হাজার ৫০০ টন গম নিয়ে এমভি সামার স্কাই এবং কানাডা থেকে ৫৯ হাজার ৮০০ টন গম নিয়ে এমভি প্রোপেল গ্রেস চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। এ দুই জাহাজ গম রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ আমদানি করেছে বলে জানা যায়।
ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে খাতুনগঞ্জে বাড়তে শুরু করে গমের দাম। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোজার ঈদের আগের দিন থেকে ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ গমের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।
খাতুনগঞ্জের গম ব্রোকার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মেসার্স আল মাওয়া করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত ঈদের আগের দিনও ভারতীয় গম ১ হাজার ৩৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু রোববার (১৫ মে) একই গম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪৬০ টাকায়। কানাডার গমের ডিও বিক্রি হয়েছে ২হাজার ৮০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী আবু তৈয়্যব বলেন, ‘দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপ খাতুনগঞ্জে হাজার হাজার টন গমের ডিও ছেড়েছে। কিন্তু দুদিন ধরে তারা পণ্য সরবরাহ দিচ্ছে না। তাদের মিলের সামনে শত শত ট্রাক আটকা পড়েছে।’
এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর ব্যবসায়ীরা গমের জন্য ভারতের দিকে ঝুঁকেছেন। কারণ এসব দেশের গমের চাহিদা বেশি। কানাডার গমের মান সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হলেও চাহিদা তুলনামূলক কম। এখন ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় খাতুনগঞ্জের বাজারে দাম বাড়তে শুরু করেছে। সোমবার ভারতীয় গম প্রতি মণ ১ হাজার ৪৭০-১ হাজার ৪৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু রেডি গম (তাৎক্ষণিক ডেলিভারি পাওয়া যাবে এমন) মণপ্রতি ৪০-৫০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে।’
পাইকারি বাজারে গমের দাম বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রক্রিয়াজাত খাবারেও। কাজির দেউড়ি এলাকার খুচরা মুদি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৭ টাকা। আমরা আগে পাইকারিতে পুষ্টি ব্র্যান্ডের যে আটা (এক কেজির প্যাকেট) ৪০ টাকায় কিনতাম, সেগুলো এখন ৪৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে। সোমবার থেকে পাউরুটির দামও বাড়িয়ে দিয়েছে বেকারিগুলো। আগে যে পাউরুটি ২৫ টাকায় বিক্রি হতো, এখন সেগুলো ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সহ-সভাপতি সৈয়দ মো. শোয়াইব হাসান বলেন, গমের দাম হু হু করে বাড়ছে। এতে প্রতিদিনই বাড়ছে ময়দার দাম। রোববার মিলগেটে যে ময়দা ৪৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সোমবার কেজিতে ২ টাকা বেড়ে ৫১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ভোজ্যতেলের পর এখন গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় অ্যাগ্রো প্রসেস শিল্প মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। তার ওপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও এ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমদানি করেই বাংলাদেশে গমের চাহিদা মেটানো হয়। এখন ভারতও গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় খাতুনগঞ্জে গমের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে।’
‘এখন টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব আমদানিতে পড়েছে, আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে। সবমিলিয়ে খাতুনগঞ্জের বাজারে বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়েছে। তেল ও গম আমদানির পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে চোখে বেশি পড়ছে।’