আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অক্সিজেনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাবার। সেই প্রাচীনকাল থেকেই একমুঠো খাবারের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ করে অসংখ্য মানুষ। তবে অর্থনীতি আর সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে খাবারের ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। আগে দরকারের বাইরে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত খাবার কথা চিন্তাই করত না, অথচ আজকাল প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষই রেস্টুরেন্টে খাবার খায়। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি রেস্টুরেন্টের বদৌলতে নানা দেশের নানা স্বাদের খাবারও আজকাল খাবার সুযোগ মিলছে। কিন্তু এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে খাবার নষ্ট আর অপচয় হওয়া।সব ধরনের খাবার সব সময় খাওয়া যায় না।অসুস্থ হলে খাওয়া দাওয়ায় কিছু বিধি নিষেধ এসে যায়।পছন্দসই খাবার আমাদের মানসিক তৃপ্তি দেয় ঠিকই, কিন্তু অনেক সময় শরীরে নানা সমস্যা তৈরি করে।করোনা হলে শরীর যেহেতু খুব দুর্বল হয়ে যায় তাই এই সময় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে করোনা হলে ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি এবং জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া খুবই দরকার।প্রসেসড ফুড,রেড মিট,সফট ড্রিংকস,মশলাদার খাবার করোনা হলে এইসব খাবার থেকে দূরে থাকা অত্ত্বাবস্যকীয়।
খাদ্য নষ্ট বা অপচয় যেভাবে হয় এখন তা নিয়ে বলি,পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত খাবারের এক-তৃতীয়াংশ খাবার নষ্ট কিংবা অপচয় হয় যেই বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (FAO) কনফির্ম করেছেন।নরমালী মনে হতে পারে খাবার নষ্ট বা অপচয় বাসা-বাড়িতেই বেশি হয়। কিন্তু বাস্তবে খাবার ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে নষ্ট হওয়া শুরু হয়। খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বেশ লম্বা একটি প্রক্রিয়া কাজ করে। আর সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় এই পর্যায়েই। তবে যেসব দেশ প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে তাদের এই ক্ষেত্রে নষ্ট হবার পরিমাণ অন্যান্য দেশগুলোর থেকে কম স্বাভাবিকভাবেই।বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় পোকামাকড় কিংবা অণুজীবের আক্রমণে ফসলের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। অনুন্নত দেশে সঠিকভাবে ফসলের যত্ন নিতে না পারার কারণে উৎপাদন কম হতে পারে। পশুপাখির খামারেও বিভিন্ন সময় রোগ দেখা দেয়। ফলে খাদ্য নষ্ট হওয়া একেবারে খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু হয়। ফসল সঠিকভাবে উৎপাদন হলেও ভোক্তা পর্যন্ত যাবার জন্য স্বল্পস্থায়ী কিংবা দীর্ঘস্থায়ী মজুদ করতে হয়। সঠিক উপায়ে মজুদ না করার কারণেই প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। এরপরে রয়েছে পরিবহনের সময় খাবার নষ্ট হওয়া। রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে খাবার নষ্ট হয়, পরিবহনের জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুত না করায় গরমে বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় কাঁচা ফল বা সবজি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাছ-মাংস পরিবহন করা গাড়ির রেফ্রিজারেটর নষ্ট হয়ে মাছ-মাংস নষ্ট হতে পারে।
উৎপাদন পর্যায়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা পরিবহন দুর্ঘটনার কারণে নষ্ট হলেও ভোক্তাদের হাতেও খাবার কম অপচয় হয় না। উন্নত দেশে অনেকেই খাবারের রঙ বা আকার একটু অন্যরকম হলেই আর কিনে না! ফলে একটু বেখাপ্পা দেখতে সবজি বা ফলগুলো শেষপর্যন্ত ময়লার ঝুড়িতেই যায়। আবার অনেকে বাসায় অতিরিক্ত খাবার কিনে রেখে দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো না খেয়ে ফেলে দেয়। দাওয়াত কিংবা রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত খাবার নিয়ে না খাওয়া তো আজকাল খুবই সাধারণ কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার প্যাকেটজাত খাবার কিনে মেয়াদ কতদিন আছে খেয়াল না করায় মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ফেলে দিতে হয়। আমাদের বাসা বাড়িতেই আমরা না খাওয়া যে খাবার ময়লার ঝুড়িতে ফেলি সেটি আমাদের দৃষ্টিতে অনেক কম মনে হলেও সামগ্রিকভাবে এভাবে প্রচুর পরিমাণে খাবার অপচয় করছি আমরা সবাই, প্রায় প্রতিদিনই!বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনগুলোতে প্রায়ই বলতে শোনা যায় “বিশেষভাবে বাছাইকৃত … দিয়ে তৈরি’’। এই বিশেষভাবে বাছাইয়ের পর বেঁচে যাওয়া ফসল বা ফলগুলোর বেশিরভাগই নষ্ট হয়। আর এভাবেই উৎপাদন পর্যায়ে বা ভোক্তার দ্বারা খাবার নষ্ট বা অপচয় না হয়েও খাবার নষ্ট হচ্ছে।
এবার আসি খাবার অপচয় রোধে আমাদের কী করণীয় থাকা উচিত, প্রতি বছর প্রায় ১৩০ কোটি টন খাবার অপচয় হয়, যার বেশিরভাগেরই স্থান হয় ভাগাড়ে এবং শেষমেশ যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে(বিবিসি নিউজ)।খাদ্যের অপচয় শুধু খাবারের অপচয় নয়, এর মানে হচ্ছে অর্থের অপচয়, পানির অপচয়, জ্বালানির অপচয়, ভূমির অপচয় এবং পরিবহণের অপচয়।সেইজন্যে কেনাকাটায় স্মার্ট হতে হবে আমাদের।খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা জানতে হবে।
১।শুরুটা বাজার করা দিয়েই করা যাক। অনেকেই বাজারে গেলেই একগাদা বাজার করে বাসায় ফেরেন, অথচ এত খাবার কেনার কিন্তু কোনো দরকারই ছিল না। এতে দেখা যায় সপ্তাহ শেষে কিছু খাবার ফ্রিজেই নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট হবার পথে। সুতরাং বাজার করার সময় অতিরিক্ত বাজার করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
২।অনেক সময় বাজার পরিমিত পরিমাণে করলেও সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোন খাবার কোথায়, কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয় এ ব্যাপারে জ্ঞান থাকাটাও জরুরি। যেমন- আলু, পেঁয়াজ খোলা জায়গায় রাখলে কিংবা শাক-সবজি ফ্রিজে বায়ুরোধক ব্যাগে রাখলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
৩।বিয়ে বা দাওয়াতের বেঁচে যাওয়া খাবার এতিমখানা বা পথশিশুদের দিয়ে দেয়া যায়। বর্তমানে বেশ কিছু সংগঠন আছে যারা এ রকম বেঁচে যাওয়া খাবার সংগ্রহ করে।
৪।নষ্ট হয়ে যাওয়া সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আজকাল অনেকেই বাসায় ফুল কিংবা সবজি চাষ করেন। কোনো খাবার ফেলে না দিয়ে সেটি দিয়ে কম্পোজিট সার বানিয়ে সহজেই গাছে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে খাবার নষ্ট হলেও অন্য কাজে ঠিকই লাগলো আবার গাছের যত্ন নেয়ার জন্য আলাদা খরচও করতে হলো না।
খাদ্যের অপচয় “এই মুহূর্তে মানবতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ,” বলেন নিউ ইয়র্কের শেফ ম্যাক্স লা মান্না।
“বেশি উদ্ভিদ, কম অপচয়” নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। এখানে তিনি বলেছেন যে, কেউ কিভাবে চাইলেই এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে সহায়তা করতে পারে।
জীবন ধারণের সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে খাবার।খাবারের অপচয় বন্ধ করা জরুরি কেন সেটা নিয়ে লিখে শেষ করছি,সবদিক বিবেচনা করলে খাবার নষ্ট বা অপচয় হলে শুধু খাবারই নষ্ট হয় এমন না, বরং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিও যুক্ত হয়।পৃথিবীতে প্রচুর মানুষ খাবার না পেয়ে মারা যাচ্ছে, অথচ এরপরেও প্রতিদিন খাবার নষ্ট হচ্ছে। আবার সমন্বয়হীনতা, সদিচ্ছা, দুর্নীতির কারণে উৎপাদিত খাবারও সবার কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।উৎপাদন পর্যায়ের কথা বাদ দিলেও ভোক্তা পর্যায়ে যে পরিমাণ অপচয় হয় তা দিয়েও অনেক পরিবারের সারা বছরের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু আমরা ব্যক্তিপর্যায়ে অন্তত নিজেদের সংশোধিত করতেই পারি। এতে হয়তো দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের মানুষেরা সরাসরি খাবার পাবে না, কিন্তু নিজের লাভটাও কম হবে না। নিজের খাবার নষ্ট করা মানে নিজের কষ্টার্জিত টাকারই অপচয়। তাই খাবার অপচয় রোধে সবারই সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।ছোট ছোট প্রচেষ্টার মাধ্যমে আপনি আপনার খাদ্য অপচয় বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারেন, অর্থ ও সময় সাশ্রয় করতে পারেন, আর কমাতে পারেন প্রকৃতির উপর থেকে কিছুটা চাপ।